পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া ও পরিবেশ বিদ্যমান।যেমন- শ্বাসপ্রশ্বাসযোগ্য বাতাস,সৌর বিকিরণ থেকে সুরক্ষা,পরিমিত তাপমাত্রা,স্থির চাপ ইত্যাদি।কিন্তু মহাশূণ্যে এসবের কোন অস্তিত্ব নেই।উদাহরণস্বরূপ বলা যায় স্থির চাপ না থাকার কারণে সেখানে অক্সিজেন পাওয়া যায় না।মহাশূণ্যের তাপমাত্রা আনুমানিক -২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।তাই মহাশূণ্যে টিকে থাকার জন্য এসব প্রতিকূল অবস্থা সামাল দিতে হয়।
স্পেসস্যুট হচ্ছে এক বিশেষ টেক্সটাইল প্রোডাক্ট যা স্পেস শাটল মিশনের সময় মহাকাশচারীদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়।এটি এক ধরনের প্রেশারাইজড গার্মেন্ট যা মহাশূণ্যের বিভিন্ন ক্ষতিকর অবস্থা থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।একটি স্পেসস্যুট এমন ভাবে ডিজাইন করা হয় যেন তা মহাশূণ্যেও পৃথিবীর ন্যায় তাপমাত্রা তৈরি করতে পারে।এটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম।যেমন- অক্সিজেনের যোগান,তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ,পরিমিত চাপের ব্যবস্থা,কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ,সূর্যের তাপ থেকে সুরক্ষা,সৌর বিকিরণ থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি ফাংশন স্পেসস্যুটে যুক্ত থাকে।মহাশূণ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য স্পেসস্যুট ব্যবহার করা হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সেখানে সেট করা,কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান প্রযুক্তির পরিচর্যা,মহাশূণ্য নিয়ে গবেষণা এবং সেখানকার স্থিরচিত্র গ্রহণ।
১৯৫০ সালে প্রথম স্পেস এক্সপ্লোরেশনের সময় স্পেসস্যুট বানানো শুরু হয়।সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে এগুলো তৎকালীন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ফাংশন এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে পরিপূর্ণ হয়েছে।বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি অনেক ধরনের উন্নত কম্পোনেন্ট দ্বারা এগুলো তৈরি করে যা সবশেষে “National Aeronautics Space Agency (NASA)” দ্বারা হউস্টনে তাদের নিজস্ব হেডকোয়ার্টারে নিরীক্ষিত হয়।একটি স্পেসস্যুটের ভর লাইফ সাপোর্ট ব্যাগপ্যাক ছাড়াই আনুমানিক ৪৭ পাউন্ড(২১ কেজি) এবং খরচ প্রায় ১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
⭕স্পেসস্যুট তৈরির জন্য যে বিষয়গুলো অতি গুরুত্বপূর্ণ–
★চাপ নিয়ন্ত্রণমূলক আবহাওয়া বিদ্যমান থাকা।
★পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা।
★স্পেসস্যুটের ভেতর সহজে যেন মুভমেন্ট করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখা।
★পরিষ্কার ভিশনের ব্যবস্থা করা।
★সঠিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকা।
★কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের ব্যবস্থা থাকা।
★অন্যান্য মহাকাশচারী ও গ্রাউন্ড কন্ট্রোলারদের সাথে যেন সহজে যোগাযোগ করতে পারা যায় সেটি নিশ্চিত করা।
★স্পেসক্রাফটের বাইরে চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান বিদ্যমান থাকা।
⭕স্পেসস্যুট ম্যানুফ্যাকচারে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদানসমূহ–
🏴ফেব্রিক উপাদানসমূহ :
★নাইলন ট্রাইকটঃ স্পেসস্যুটের একদম ভেতরের লেয়ার তৈরিতে নাইলন ট্রাইকট ফেব্রিক ব্যবহার করা হয়।
★স্প্যানডেক্সঃ স্প্যানডেক্স হল এক ধরনের ইলাস্টিক ফেব্রিক ও পরিধানযোগ্য পলিমার যা স্পেসস্যুটের মধ্যবর্তী আরেকটি লেয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
★ইউরিথেন কোটেড নাইলনঃ এটি স্পেসস্যুটের মধ্যভাগের একটি লেয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় যা চাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
★নিওপ্রেন কোটেড নাইলনঃ এটি স্পেসস্যুটের মধ্যবর্তী আরেকটি লেয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।এই লেয়ারটি চাপ ধরে রাখতে পারে।
★ডাকরনঃ এটি এক ধরনের পলিএস্টার ফেব্রিক যা চাপ হ্রাসকারক লেয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
★মাইলারঃ অ্যালুমিনাইজড মাইলার এক ধরনের সিন্থেটিক ফেব্রিক যা তাপ নিয়ন্ত্রণকারী লেয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
🏴নন-ফেব্রিক উপাদানসমূহ :
★ফাইবারগ্লাসঃ এটি স্পেসস্যুটের উপরের শক্ত টর্সো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
★লিথিয়াম হাইড্রোক্সাইডঃ এটি স্পেসস্যুটের ভেতর ফিল্টার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় যেটি স্পেস ওয়াকের সময় কার্বন ডাই অক্সাইড ও জলীয়বাষ্প নিঃসরণ করে থাকে।
★সিলভার-জিংক ব্লেডঃ স্পেসস্যুটের ভেতর বিভিন্ন ফাংশন কার্যকর রাখার জন্য একটি ব্যাটারী দ্বারা সম্পূর্ণ স্যুটে শক্তি সরবরাহ করা হয়।সিলভার-জিংক ব্লেড হল ঐ ব্যাটারীর একটি মৌলিক উপাদান।
★প্লাস্টিক টিউবঃ এই টিউবটি একটি ফেব্রিক লেয়ারের মধ্যে সেলাই করা থাকে।টিউবটি দ্বারা স্যুটের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় শীতল পানি সরবরাহ করা হয়।
★পলিকার্বনেট ধাতুঃ হেলমেটের আবরণ সুগঠিত ভাবে তৈরি করার জন্য পলিকার্বনেট ধাতু ব্যবহার করা হয়।
⭕স্পেসস্যুটের গাঠনিক অংশ–
⚫লিকুইড কুলিং ভেন্টিলেশন গার্মেন্ট(LCVG) :
নাইলন ট্রাইকট এবং স্প্যানডেক্স এর মাধ্যমে তৈরি এক ধরনের আন্ডারগার্মেন্ট যার সাথে টিউব সংযুক্ত থাকে।মহাকাশচারীর দৈহিক তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে উক্ত টিউবটি থেকে শীতল পানি পরিবহনের মাধ্যমে তাপমাত্রা নিবারণ করে।
⚫কমিউনিকেশন ক্যারিয়ার অ্যাসেম্বলি(CCA) :
মহাকাশচারী দ্বারা পরিহিত এক ধরনের টুপি যা টেফলন ও নাইলন কাপড়ের তৈরি।এই টুপির সাথে মাইক্রোফোন ও ইয়ারফোন সংযুক্ত থাকে যার মাধ্যমে অন্যদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়।
⚫ম্যাক্সিমাম এবজরপশন গার্মেন্ট(MAG) :
স্পেসওয়াকের সময় দৈহিক বর্জ্য পদার্থ জমা করে রাখে।
⚫হার্ড আপার টরসো(HUT) :
এটি একটি শক্ত ফাইবার গ্লাসের আবরণ।এটি স্পেসস্যুটের উপরের বিভিন্ন অংশ যেমন- আর্মস,হেলমেট,কন্ট্রোল মডিউল,লাইভ সাপোর্টিং ব্যাগপ্যাক ইত্যাদিকে সাপোর্ট দিয়ে থাকে।
⚫হেলমেট :
এটি পরিষ্কার ও প্রভাবমুক্ত পলিকার্বনেট প্লাস্টিকের তৈরি এবং একটি আংটার মাধ্যমে HUT এর সাথে সংযুক্ত থাকে।হেলমেটের ভেতর সব সময়ই অক্সিজেন প্রবাহ বিদ্যমান থাকে।বিশেষ অবস্থায় অতিরিক্ত অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে হেলমেটের ভেতর অবস্থিত প্যার্জ ভালভের মাধ্যমে র্কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরিত হয়।
⚫আর্মস :
আর্ম ইউনিট কাঁধ,বাহুর উপরের অংশ এবং কনুইয়ের স্বাচ্ছন্দ্য মুভমেন্টে সহায়তা করে।আর্মসের সাইজ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়।
⚫গ্লাভস :
গ্লাভস মূলত কব্জির মুভমেন্টে সহায়তা করে।গ্লাভস গুলো একটি আংটার মাধ্যমে আর্মসের মাধ্যমে যুক্ত থাকে।কোন জিনিসে সঠিক গ্রিপ পাবার জন্য গ্লাভসে রাবারের তৈরি ফিংগার টিপস থাকে।এছাড়াও হাতের নমনীয়তা রক্ষার্থে গ্লাভসের ভেতরের অংশে ফাইন-ফেব্রিক নামক আরেকটি গ্লাভস থাকে।
⚫লোয়ার টরসো অ্যাসেম্বলি(LTA) :
স্পেসস্যুটের কোমরের নিচের অংশগুলো তথা প্যান্ট,হাঁটু ও গোড়ালির জয়েন্টের আবরণ,বুট ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত।একটি ধাতব আংটার মাধ্যমে এগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকে। LTA লুপ তৈরির মাধ্যমে যন্ত্রপাতির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং এগুলো মহাশূণ্যে ভেসে যাওয়া থেকে প্রতিহত করে।
⚫ইন-স্যুট ড্রিংক ব্যাগ(IDB) :
প্লাস্টিকের তৈরি একটি ব্যাগ যা প্রায় ২ লিটার পানি সংরক্ষণ করতে পারে এবং HUT এর ভেতর অবস্থান করে।এর সাথে একটি নল সংযুক্ত থাকে যেটি হেলমেটের ভেতর মহাকাশচারীর মুখের পাশে অবস্থান করে।
⚫থার্মাল মাইক্রোমেটেওরয়েড গার্মেন্ট(TMG) :
এটি স্পেসস্যুটের একটি বহিঃআবরণ।এর কাজগুলো হচ্ছে স্যুটের ভেতর সরবরাহকৃত তাপশক্তির অপচয় রোধ করা,ক্ষতিকর সৌর বিকিরণ থেকে সুরক্ষা প্রদান করা এবং মাইক্রোমেটেওরয়েডস তথা স্পেসস্যুটের ক্ষতিসাধন করতে পারে এমন উপাদানসমূহ থেকে মহাকাশচারীকে রক্ষা করা।
⭕সোর্সঃ গুগোল,উইকিপিডিয়া।
সাদমান সাকিব
বস্ত্রকৌশল বিভাগ
২ক১৯
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,
খুলনা।