অবহাওয়ার সাথে মানব দেহের ভারসাম্য রক্ষায় মধ্যমা হিসেবে থাকে পোশাক। শীতের সময় যেমন মোটা কাপড় প্রয়োজন হয়, ঠিক তেমনই গরমে দরকার আরামপ্রিয় মোলায়েম সুতি কাপড়। গরমের দিনে পুরুষের আরামদায়ক পোশাক হিসেবে বেছে নেওয়া হয় স্যান্ডো গেঞ্জি। স্যান্ডো গেঞ্জি শুধু গরমের জন্য একটি আরামদায়ক পোশাক নয়, এটি ফ্যাশনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রাকৃতিক কাপড় যেমন সুতি দিয়ে তৈরি স্যান্ডো গেঞ্জি শরীরকে শুষ্ক ও স্বস্তিদায়ক রাখে। বিশেষ করে গরমের দিনে যারা স্টাইল ও আরামের সমন্বয় খোঁজে, তাদের জন্য এটি একটি অপরিহার্য পোশাক।

স্যান্ডো গেঞ্জির ইতিহাস
স্লিভলেস বা হাতাকাটা শার্ট বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে স্যান্ডো গেঞ্জি নামে পরিচিত। ইতিহাস থেকে জানা যায় ব্রিটিশ আমল থেকেই এই হাতাকাটা বিশেষ পোশাক পরার চল শুরু হয়।
স্যান্ডো গেঞ্জির স্যান্ডো শব্দটি এসেছে সম্ভবত ‘গানজি’ থেকে। গানজি হলো উলে বোনা এক ধরনের সোয়েটার যা ব্রিটিশ নাবিকরা পরিধান করতো। এছাড়া অস্ট্রেলিয় ফুলবল খেলোয়াড়েরা একধরনের হাতাকাটা পোশাক পরতেন যেটা গানজি নামে পরিচিত ছিলো।
স্যান্ডো শব্দটি জাপানিজ এক বডি বিল্ডারের নাম থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। তাঁর নাম ‘ইউজেন স্যান্ডো’। তিনি ১৮ শতকের শেষ দিকে বডি বিল্ডার হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তাঁকে আধুনিক বডি বিল্ডিংয়ের জনক বলা হয়। সেখান থেকেই তাঁর পরিচিতি পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ ১৯০৫ সালে ভারত সফর করেন স্যান্ডো, জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়।

বিচিত্র ধরনের হাতাকাটা পোশাক পড়তেন স্যান্ডো। এই পোশাক পড়েই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। তাঁর পরিহিত হাতাকাটা শার্ট বা গেঞ্জিকেই বলা হয় স্যান্ডো গেঞ্জি। ধারণা করা হয়, বাংলার মানুষ তাঁর অনুরাগী হওয়ার ফলে আবেগপ্রবণতার বসে তাঁর নামের সাথে মিলিয়ে এই স্লিভলেস বা হাতাকাটা গেঞ্জির নাম দেয় স্যান্ডো গেঞ্জি।
বাংলাদেশে স্যান্ডো গেঞ্জির ব্যবহার
ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলাদেশে স্যান্ডো গেঞ্জির প্রাথমিক ব্যবহার শুরু হয় । প্রথম দিকে ইউরোপীয় সেনা ও কর্মকর্তারা পরিধান করলেও ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষরাও এটি ব্যবহার শুরু করে, বিশেষত শ্রমিক শ্রেণি ও কায়িক পরিশ্রমে যুক্ত ব্যক্তিরা। ১৯৪৭ সালের পরেও পূর্ব পাকিস্তানে স্যান্ডো গেঞ্জির ব্যবহার বাড়তে থাকে, এই সময়ে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে এটি ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়, কারণ এটি সহজেই ঘামে ভিজে গেলেও আরামদায়ক থাকত।
বাংলাদেশে স্যান্ডো গেঞ্জির উৎপাদন
১৯৪৭ সাল থেকে স্থানীয়ভাবে স্যান্ডো গেঞ্জির উৎপাদন শুরু হয় এবং ঢাকার আরামবাগ, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের কিছু কারখানায় এগুলো তৈরি হতে থাকে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্পের বিকাশ ঘটে। নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকায় ছোট ছোট গার্মেন্টস কারখানা তৈরি হতে থাকে, যেখানে দেশীয় তুলা ও ফেব্রিক থেকে স্যান্ডো গেঞ্জি তৈরি শুরু হয়। বিভিন্ন ব্র্যান্ড যেমন DOEL, Crown, Partex, Bangla T-shirt ইত্যাদি স্যান্ডো গেঞ্জি তৈরি শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশে স্যান্ডো গেঞ্জি শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারেই নয়, রপ্তানি ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্র্যান্ড বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে স্যান্ডো গেঞ্জি উৎপাদন করে। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে উন্নতমানের কটন ও সুতার মিশ্রণে তৈরি আরামদায়ক ও ফ্যাশনেবল স্যান্ডো গেঞ্জি বাজারে আসছে।
বাংলাদেশ থেকে স্যান্ডো গেঞ্জি রপ্তানি
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, এবং স্যান্ডো গেঞ্জি (Tank Top বা Sleeveless Undershirt) রপ্তানি খাতেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বিশেষ করে সস্তা উৎপাদন খরচ, গুণগত মান এবং দক্ষ শ্রমশক্তির কারণে বাংলাদেশ থেকে স্যান্ডো গেঞ্জি আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা পেয়ে আসছে।
বাংলাদেশ থেকে স্যান্ডো গেঞ্জি মূলত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশ (বিশেষত জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি), কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান-এ রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশী কোম্পানিগুলো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ও দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক প্রস্তুতকারক কোম্পানি যেমন H&M, Zara, Walmart, Uniqlo, Adidas, Ha-Meem Group, DBL Group, Square Textiles, Epyllion Group, Fakir Apparels ইত্যাদির জন্য স্যান্ডো গেঞ্জি তৈরি করে।
২০২৫ সালের মার্চ মাসের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে টি-শার্ট স্যান্ডো গেঞ্জি রপ্তানিতে দ্বিতীয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বিদের অবস্থান এক নজরে-

স্যান্ডো গেঞ্জি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারেই ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ার উপযোগী আরামদায়ক পোশাক হিসেবে এটি দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয়। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ও প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে বর্তমানে এটি শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদাই মেটাচ্ছে না, বরং বৈশ্বিক বাজারেও প্রতিনিধিত্ব করছে।
ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তি, ডিজাইন, ইনোভেশন এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্যান্ডো গেঞ্জি শিল্প আরও বিকশিত হতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার, ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।
Writer:-
খাদিজা খাতুন
সাধারণ সদস্য, কনটেন্ট রাইটিং টিম, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারস সোসাইটি।
পাবনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পাবনা।