মানবসভ্যতা কে সভ্য ভাবে উপস্থাপন করার মৌলিক নিয়ামক গুলোর মধ্যে পোশাক অন্যতম। প্রাচীনে গাছের বাকল থেকে শুরু করে বর্তমানের প্রযুক্তি খচিত পোশাক সবই মানবসভ্যতার পালাবদলের জ্বলন্ত উদাহরণ।একসময় আদী মানবরা গাছের যে বাকল কে সরাসরি পরিধান করতো, আজ আধুনিক বিশ্বের মানবরা গাছের সে বাকল থেকেই তন্তু পৃথক করে বুনছে দৃষ্টিনন্দন সব পরিধেয় বস্ত্র।হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্ম উদ্ভাবন করবে আরো আধুনিক সব প্রযুক্তি খচিত পোশাক। যে যাই হোক, অতীতের জ্ঞান কে পুজি করে বর্তমানের গবেষণার উপরে ভর করেই পৌঁছাতে হবে ভবিষ্যতে। আর বর্তমানের গবেষণার এক যুগান্তকারী সাফল্য হলো “সয়া ফাইবার”। যুগান্তকারী আবিষ্কার এ সয়া ফাইবারকে নিয়েই আজকের এ বিশ্লেষণ মূলক লেখাটি সাজানো।
একবিংশ শতাব্দীতে পোশাক ব্যবস্থাকে আরো তরান্বিত করে উপস্থাপন করবার লক্ষ্যে সকল বাধা অতিক্রম করে তীব্র গতিতে সামনে এগিয়ে যাওয়া ফাইবারগুলোর একটি সয়া ফাইবার বা সয়াবিন ফাইবার।আরামদায়ক এর সাথে স্বাস্থ্যকর শব্দটি যোগ করে আরো পূর্ণতা লাভ করেছে এ ফাইবার।সয়া অর্থাৎ সয়াবিন মূলত চাষ করা হয় বীজের জন্যই ।যার উদ্ভব হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় পাচ হাজার বছর আগে এশীয় দেশ চীনে।যা কিনা উদ্ভিজ্জ আমিষ হিসেবে দীর্ঘদিন আমিষের চাহিদা মিটিয়ে আসছে।এছাড়াও সয়াবিন হাজার হাজার বছর ধরে প্রাচ্য দেশগুলির অন্যতম প্রধান খাদ্য।ইউরোপ আমেরিকাতেও সয়াবিন বর্তমানে ভোজ্যতেল এবং প্রোটিনের উৎস হিসাবে প্রচুর পরিমাণে চাষ করা হয়। আমিষ উৎপদনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরা সয়াবিন বীজ এর মাঝে তন্তু প্রস্তুত এর বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষন করেন এবং সর্বপ্রথম ১৯৩৯ সালে সয়া বীজ থেকে তন্তু উৎপাদন শুরু হয়েছিল।তবে পর্যাপ্ত সহযোগিতা, জনবলের ঘাটতি সহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে কয়েকবছরের মাঝেই গতি হারায় সয়া ফাইবার প্রস্তুত প্রক্রিয়া। কিন্তু তাই বলে কি বন্ধ থাকবে সম্ভাবনাময় এ ফাইবার প্রস্তুত প্রক্রিয়া? না থেমে থাকেনি। একটা সময়ে সকল প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে নব রূপে যাত্রা শুরু করে সয়া ফাইবার বা সয়াবিন ফাইবার।
প্রতি ১০০ কেজি সয়াবিনের অবশিষ্টাংশ ৪০ কেজি পর্যন্ত সয়া ফাইবার প্রস্তুত করা যেতে পারে। সয়াবিন ফাইবার সাধারণত ওয়েট স্পিনিং পদ্ধতি দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। স্পিনিং প্রক্রিয়াটি স্পিনিয়ারেট যন্ত্রের সাহায্যে স্পিনিং দ্রবণকে দ্রবীভূত করে। স্পিনিয়ারেটে মধ্যে বেশ কয়েকটি গর্ত থাকে যা পরবর্তীতে একটি জমাট বাথে উদ্ভূত হয়। স্পিনেরেট গর্ত থেকে উদ্ভূত দ্রবণটিকে একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমে প্রবাহিত করা হয় যেটি সাধারণত ২% সালফিউরিক অ্যাসিড এর সাথে ডিহাইড্রেশনের জন্য ১৫% সোডিয়াম সালফেট বা সোডিয়াম ক্লোরাইডযুক্ত দ্রবণ হয়ে থাকে।পরবর্তীতে জমাট বাথের তরল মাধ্যমটি সূক্ষ্ণ ফিলামেন্ট হিসাবে অনুভূত হয়। ফাইবার গুলোলে দৃঢ় করার জন্য খুব ভালো ট্রিটমেন্ট এর প্রয়োজন পড়ে।যা পৃথক বাথের মাধ্যমে করা যেতে পারে।যখন ফিলামেন্ট নরম হয় তখন এর অণুগুলির পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে মিশ্রণকে তরান্বিত করে যেটি ফিলামেন্টগুলির শক্তি এবং স্থায়িত্ব বাড়ায়।ফিলামেন্ট গুলোকে আরো শক্তিশালী করার জন্য প্রধানত হাইড্রোফর্মাইলেশন মাধ্যমে চালনা করা হয়। এরপর একটি নিয়ন্ত্রিত স্থানে নির্দিষ্ট আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রার মাধ্যমে ফিলামেন্ট গুলোকে শুকানো হয় এবং এরপরেই এটি প্রয়োজন মতো দৈর্ঘ্যে কাটিং হয় । সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে এবার ফাইবার গুলো বাজারজাত করনের জন্য প্রস্তুত।
এতক্ষন তো ক্ষুদ্র পরিসরে জানছিলাম সয়া ফাইবারের প্রস্তুত প্রণালী।এবার জানা যাক ফাইবারটির প্রায়োগিক দিক গুলো সম্পর্কে।সয়া ফাইবার সাধারণত খুবই সূক্ষ্ম হয়ে থাকে এবং ফাইবারটি খুব ভালো আদ্রতা শোষণ করতে পারে। ফাইবারের একটি বিশেষ গুন হলো, এটি অনেকাংশেই রেশম এর মতো তাই পোশাকের গুনমান বাড়াতে এটি রেশম এর সাথেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার অনেকেই মনে করেন তুলোর চেয়ে সয়া ফাইবার বেশি আরামদায়ক। আর উপর্যুক্ত গুণ গুলোর কারণেই সয়া ফাইবার বিভিন্ন অনুপাতে অন্য যেকোন ফাইবারের সাথে মিশ্রিত করে দামী সেই সাথে আরামদায়ক পোশাক প্রস্তুত করা হয়ে থাকে।চলুন এবার জানা যাক সয়া ফাইবারের আনুপাতিক মিশ্রনে প্রস্তুত নানা রকম পোশাক সম্পর্কে। সয়াবিন এর সাথে কাশ্মিরি উল মিশ্রিত করে প্রস্তুত করা হয় ঐতিহ্যবাহী কাশ্মিরি সোয়েটার, শাল এবং কোটের মত চমকপ্রদ পোশাক৷ আবার সয়া ফাইবার এর সাথে সিল্ক বা রেশম মিশ্রিত করে স্লিপওয়্যার, ছেলেদের শার্ট সহ মেয়েদের দামি শাড়ি ও প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। এদিকে সয়া ফাইবারের সাথে কটন মিশ্রিত করে পোশাক প্রস্তুত করলে পোশাক প্রচুর আরামদায়ক হয়ে থাকে এবং গরমকালে শরীরের ঘাম শোষণের পাশাপাশি ব্যাকটিরিয়া প্রতিরোধো করে থাকে যা নবজাতক শিশুদের জন্য খুবই উপযোগী হয়ে থাকে।
এছাড়াও সয়া ফাইবারের সাথে সিন্থেটিক ফাইবার মিশ্রিত করে গ্রীষ্মের জন্য পোশাক, ছেলেদের শার্ট এবং স্পোর্টওয়্যার প্রস্তুত করা হয়।আরো একভাবে মিশ্রিত করা যায় সয়া ফাইবার। সাধারণত সয়া ফাইবার ও স্প্যানডেক্স ফাইবার মিশ্রিত করে ফ্যাব্রিকটি আরও স্থিতিস্থাপক হয় সেই সাথে ওয়াশিং এবং কেয়ারিংয়ের জন্য সহজ হয়ে যায়।সয়া ফাইবারের গুণাগুণ এবং ব্যবহার ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। কিন্তু কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল না হওয়ায় অনেক দেশই সয়া চাষ করতে না পারায় বিশ্বব্যাপী এর বিস্তার খানিক স্থবির। আমাদের দেশেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি।তবে কৃষিবিদ দের ব্যাপক প্রচেষ্টায় আমরাও সেই সুদিন থেকে বেশি দূরে অবস্থান করছিনা। সময়ের সাথে বদলে যাবে দেশের পোশাক শিল্প সেই সাথে আরো সমৃদ্ধ হবে পোশাক ব্যবস্থাপনা এই হোক সকলের প্রত্যাশা।
তথ্যসূত্র : fibre2fashion
লেখক:
মুনতাসির রহমান
Department Of Textile Engineering
Batch:201
BGMEA UNIVERSITY OF FASHION AND TECHNOLOGY