নিজেকে সভ্য দেখানাের উদ্দেশ্য নিয়ে আদিমযুগের মানুষ প্রথম পােশাক ব্যবহার করতে শুরু করে।অার এভাবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পােশাক শােভাবর্ধক ও রুচিবােধ ইত্যাদি বিষয়ের দিকে গুরুত্ব সূচক হয়ে পড়ে।যার ফলে টেক্সটাইল শিল্পের পরিব্যপ্তি বিস্তৃত আকার ধারণ করে।
টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হিসেবে হােম টেক্সটাইল খ্যাত।হোম টেক্সটাইল বলতে ঘরােয়া শােভাবর্ধক হিসেবে ব্যবহৃত টেক্সটাইলকে বুঝায়। তাই একে হােমটেক বা ঘরােয়া টেক্সটাইলও বলা হয়।সময়ের সাথে পরিবর্তন হয় চাহিদার অার সে চাহিদা যদি হয় ঘরােয়া শােভাবর্ধনের তাহলে হােম টেক্সটাইলের কথা না বললে নয়।
★হােম টেক্সটাইলের মধ্যে রয়েছেঃ
বিছানা চাদর,বালিশ,বালিশের কাভার,টেবিল ক্লথ,দস্তানা,পর্দা, মশারি,ফ্লোরিং কার্পেট,ফার্ণিচার ফেব্রিক,তাকিয়া,তােশক,ছােট গালিচা ইত্যাদি।
হােম টেক্সটাইলে ব্যবহৃত ফাইবার এবং ডিজাইনিং প্রাকৃতিক অংশ ছাড়াও তুলা,রেশম,পশম,লিনেন
জাতীয় ফাইবার গুলো হােম টেক্সটাইল তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।মানুষের তৈরি বিভিন্ন ফাইবার যেমনঃ পলিয়েস্টার,নাইলন,পলিপ্রােপিন,টেফলন, এক্রাইলিক ইত্যাদিও ব্যবহার হচ্ছে। সম্প্রতি বাজারে কিছু আধুনিক তন্তু হোম টেক্সটাইল এর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন-Sendura,Varie,Lintex,Crinkle ইত্যাদি।
দ্রুত পরিবর্তিত বিশ্বে হােম সজ্জা ক্ষেত্রটি সমস্ত পরিবর্তনের জন্য খুব সংবেদনশীল। সে কারণেই উদ্ভাবনী ও আধুনিক নকশা এবং মােটিফ তৈরি করা প্রয়ােজন।বাংলাদেশী হােম টেক্সটাইল নির্মাতারা ফ্যাশন তৈরি এবং ডিজাইন সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন যা তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে একটি বিশেষ স্থান অর্জন করতে সক্ষম করে।অাধুনিক ডিজাইন সজ্জা ফ্যাশনের স্পন্দনে একটি আঙ্গুল রাখে এবং ক্রেতাদের স্বাদ,পছন্দ পূরণ করে।
★বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানঃ
বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল কারখানা গুলি ওভেন বা নিট পােশাকের তুলনায় খুব কম।ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রামের ২৫-৩০টি প্রতিষ্ঠান হােম টেক্সটাইল উৎপাদন করছে।এর মধ্যে রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে জাবের এন্ড জুবায়ের ফেব্রিক,সাদ গ্রুপ,অলটেক্স, ক্লাসিক্যাল হোম,রিজেন্ট, জেকে গ্রুপ ইত্যাদি। বাংলাদেশে হোম টেক্সটাইল নেতৃত্ব দিচ্ছে নোমান গ্রুপের জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স। আন্তর্জাতিকভাবে হোম টেক্সটাইল বাজারে অবস্থান করে নেওয়ার প্রত্যয় থেকে ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করে এই প্রতিষ্ঠান। ২০০০ সালের মার্চ মাস থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যায়।অন্যদিকে চট্টগ্রামের সাদ মুসা গ্রুপ ১৯৯৪ সালে যাত্রা শুরু করলেও হােম টেক্সটাইল রপ্তানি শুরু করে আরও চার বছর পর।
★হোম টেক্সটাইল ও বাংলাদেশঃ
হোম টেক্সটাইল বাংলাদেশের প্রথম লাইন রপ্তানি খাত যা আলংকারিক টেক্সটাইল নামেও পরিচিত।পণ্যের গুণমান এবং বৈচিত্র্যময় পরিসরের কারণে বাংলাদেশে হােম টেক্সটাইল উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় শিল্প উদ্যোক্তরা হােম টেক্সটাইল তৈরির যাত্রা শুরু করে। বাংলাদেশ ১৯৮০ এর দশকে প্রথম হােম টেক্সটাইল রপ্তানির বাজারে প্রবেশ করেছিল।স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশবান্ধব পণ্যের জন্য ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রতি অন্তর্জাতিক বাজারে যে প্রবণতা রয়েছে সে সম্পর্কে অাজ বাংলাদেশী হােম টেক্সটাইল শিল্প সচেতন ও প্রযুক্তিগত বিধিমালায় উন্নতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।বর্তমানে খাতটির অনেক প্রতিষ্ঠান গুণমান ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা সিস্টেমসহ উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে।
★হােম টেক্সটাইল ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক অবস্থাঃ
এক দশক আগেও আন্তর্জাতিক বাজারে হােম টেক্সটাইল পণ্যে বলতে ক্রেতারা বুঝত চীন,ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের কথা।এক দশক পরে এসে চারটি দেশের সাথে যুক্ত হলাে বাংলাদেশ।বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারিং এক্সপাের্টস।
এসোসিয়েশন এবং এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো মতে, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে হােম টেক্সটাইল রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল সাড়ে ১৫ কোটি ডলার। আর গত ২০১০-১১ অর্থবছরে এই রপ্তানি আয় বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৯ কোটি ডলার।আর তা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫৩ মিলিয়ন ডলার। প্রায় প্রতিবছরই তা উল্লেখযােগ্য হারে বেড়ে চলেছে।
আইকিয়া, ক্যারিফোর, অ্যাডা, লিটল উড, মরিস ফিলিপস, ওয়ালমার্ট ও রেড ক্যাটের মতাে ইউরােপ ও আমেরিকার বড় বড় খুচরা বিপণি সংস্থাগুলাে বাংলাদেশ থেকে বর্ধিত হারে হােম টেক্সটাইলের বিভিন্ন সামগ্রী আমদানি করছে। এভাবে চাহিদা বাড়তে থাকায় দেশীয় উৎপাদকেরাও তাদের উৎপাদনের পরিসর বাড়াচ্ছে, যাচ্ছে বড় ধরনের শিল্পের সম্প্রসারণে।
★টেকসই প্রবৃদ্ধি হিসেবে হােম টেক্সটাইলঃ
বর্তমানে বাংলাদেশ পণ্যে তৈরিতে সর্বাধিক টেকসই পরিবেশ বিবেচনা করে।টেক্সটাইল কারখানা গুলি টেকসই অনুশীলনের মাধ্যমে অসংখ্য পণ্যে উৎপাদন করতে কাজ করছে যা ক্রেতারা প্রশংসা করছেন।এই সংস্কৃতি দেশের হােম টেক্সটাইল ব্যবসাকে এগিয়ে রাখবে।যার ফল টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে অবদান রাখছে।
★হােম টেক্সটাইল ও বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতাঃ
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে,হােম টেক্সটাইল খাতের জন্য তুলার দাম ও জোগানই সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে জানান উদ্যোক্তরা। চীন, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে এখানেই। তারা নিজেরাই ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন খরচ সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নিজস্ব তুলার জোগান থাকার কারণে। আর বাংলাদেশকে নির্ভর করতে হয় বিশ্ববাজারের দামের ওঠানামার ওপর। কারণ বাংলাদেশের তুলার চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানাে সম্ভব। বাকি ৯৮ শতাংশই আমদানি করতে হয়।
পরিশেষঃ
বাংলাদেশে হােম টেক্সটাইল ব্যবসায়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে।তবে নতুন নতুন চিন্তা ভাবনা এবং পর্যাপ্ত গবেষণার সুযােগ তৈরি করার প্রয়ােজন রয়েছে।নতুন উদ্যোক্তা এবং বিনিয়ােগকারীদের এই খাতে এগিয়ে আসতে হবে।হোম টেক্সটাইল সীমাবদ্ধতাগুলো মূর্ছনা করে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই সেক্টরের সূদুর প্রসারের জন্য সরকার এবং বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অনস্বীকার্য।
লেখাঃ
মো:মামুন হক
সিটেক