“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়!
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়?
আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।”
সময়ের চক্রে আবর্তিত হচ্ছে ফ্যাশন। পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে স্টাইল পরিবর্তিত হলেও ফ্যাশন কোনো না কোনোভাবে নতুন রূপ ও বৈচিত্র্য নিয়ে ফিরে আসছে আবার আমাদের মাঝে! ৭০ দশকের সবকিছুতেই ছিল নতুন করে আবার শুরু করার আমেজ। সাথে যুক্ত হয় ভিন্নধারার ফ্যাশন, যা আগের সব ফ্যাশন ট্রেন্ডকে ছাড়িয়ে তার একটা নিজস্ব জায়গা করে নেয়। এজন্য এসময় কালকে ফ্যাশনের ইতিহাসে সবচেয়ে “উজ্জ্বল ও কিংবদন্তি” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
মানুষের চাল-চলন, পোশাক-আশাক ও সাজ-সজ্জায় মিডিয়ারও যে একটা বড় প্রভাব রয়েছে তা উল্লেখ না করলেই নয়! তবে ৭০’রের দশক ছিল বাংলা সিনেমার অন্যতম বিশেষ সময়। বাংলার কালজয়ী সিনেমাগুলি তৈরি হয়েছিল এসময়েই। সেইসাথে মিডিয়া কাঁপানো চলচ্চিত্র তারকারাও হাজির হতেন নিত্য নতুন ফ্যাশন স্টাইল নিয়ে।
সে যুগে চালু হওয়া “বল প্রিন্টের শাড়ি”-র জনপ্রিয়তা এখনো পর্যন্ত বহাল রয়েছে। তবে ৭০ দশকের নায়িকাদের পরনে এ শাড়ি বেশি দেখা যেত। এসময়ের পোশাকে অন্যতম আকর্ষণ ছিল “ফ্লোরাল প্রিন্ট”। তখনকার সময়ে কাপড়ে জরি, পুঁতি, চুমকি, ডলারের ব্যবহার দেখা না গেলেও, দেখা যেত ডিজাইনে মাধুর্যতা! স্লিভলেস ব্লাউজ ছাড়াও ছিল ঘটিহাতা, পিস্তলহাতা, চুড়িহাতার ব্লাউজ আর স্যালোয়ারে ছিল ধুতি, চুড়িদার, পেশোয়ারি, পাটিয়ালি এবং সাথে লম্বা কামিজ। যাকে বলা চলে, সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস! এসময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ফ্যাশন ছিল মখমলের পোশাক।
লম্বা কালো চুল ছিল তখনকার সময়ে রুপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য! লম্বা ঘন চুল ফুলিয়ে বাঁধার চল এসময়েই শুরু হয়েছিল নায়িকা ববিতার মাধ্যমে। এ দশকের প্রধান দুইজন ফ্যাশন আইকন হলেন, কোকিলাকণ্ঠী রুনা লায়লা ও ফ্যাশন খ্যাত নায়িকা ববিতা। যাদের প্রতিভা ও স্টাইল বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণীরা অনুসরণ করে আসছে। এছাড়া পনিটেল এবং স্টেপস্, বব, বান, ব্যঙ্গস্ এর মতো হেয়ারস্টাইলগুলো এসময়েরই সৃষ্টি। সে সাথে চুলে ব্যবহার করত রং-বেরঙের ফিতা ও ব্যান্ডস্। তবে বেশিরভাগ ধনী ঘরের মেয়েদের মাঝে শর্ট হেয়ারস্টাইলের ব্যাপক প্রচলন ছিল।
টানা কাজল, ডাক লিপস্টিক ছিল এসময়ের প্রধান সাজ। তবে সে সময়ে এখনকার মতো এত মেকাপের প্রচলন ছিল না। সাজও ছিল তখনকার শাকসবজির মতো নির্ভেজাল ও ফ্রেশ। তা বলে এখনকার সময়ের অতিরিক্ত মেকআপ ও সাজসজ্জাকে ছোট করে দেখারও উপায় নেই! মেকআপকে যদি আমরা মেয়েদের তৈরি নকশিকাঁথা টাইপ শিল্পকর্মের সাথে তুলনা করি, তাহলেই কেবল আমরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হব। সময়ের সাথে সাথে বিস্তৃত হওয়াই তো শিল্পের ধর্ম, তাই না? আর আমরা বাঙালি জাতি সবসময়ই সবরকম শিল্পকর্মকে শ্রদ্ধা করে আসছি। তবে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন অনুশীলন ও গভীর ভক্তি। যার কারণে একদিকে যখন মেকআপ শিল্পের ঘটছে বিপ্লব তখন অন্যদিকে নকশিকাঁথা কিংবা টেরাকোটার মতো শিল্পগুলো বিলুপ্তির পথে!
এছাড়াও সত্তরের দশকে ফুলেল ও মাটির তৈরি অলংকারের বেশ প্রচলন ছিল। পোশাকের সাথে ম্যাচিং করে নানা ধরণের উজ্জ্বল গয়না পরার চল তখন থেকেই শুরু। আর জুতার মধ্যে ছিল পাম্প হিলস্, ফানকি বাউলিং, ওপেন টু স্যান্ডেলস্।
অপরদিকে তখনকার সময়ে পুরুষদের ফ্যাশনও ছিল খুবই চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর। যেমন v-ঘাড় ও স্ট্রাইপযুক্ত মখমলের শার্ট, প্রজাপতি কলার, টাইট ফিটিং টি-শার্ট, প্যাটার্নযুক্ত পোশাক, জাম্পস্যুট এবং টেনিস ক্যাপ হলো এসময়ের সৃষ্ট অন্যতম ফ্যাশন। তাছাড়া শার্টের বোতাম বাড়িয়ে খোলা রেখে বুকের লোম প্রদর্শন করাও ছিল এসময়ের অন্যতম ফ্যাশন! আর জুতার ফ্যাশনে ছিল হাই বুটস, রকিং মোজা, গ্র্যান্ড কোর্ট সুজ।
সত্তরের দশকের ফ্যাশন স্টাইলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমানে ফ্যাশনের অধিকাংশেই এর প্রভাব বিদ্যমান। তখনকার সময়ের নারী-পুরুষেরাও ছিল সাহসী ও ফ্যাশন সচেতন, যা বর্তমানে নারী-পুরুষের মাঝে এক ভাগও নেই! এর কারণ হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ারকেও দায়ী করা চলে! এর মাধ্যমে যেমন একদিকে সবকিছু ছড়িয়ে পড়ে, অপরদিকে ব্যক্তি বিভিন্ন ধরণের নেগেটিভ ট্রোলিং এরও শিকার হন। যার কারণে অনেকেই নিজেদের সৃজনশীলতা ও প্রতিভা সকলের মাঝে তুলে ধরতে ভয় পায়।
“ঢাকার চারশ বছর”-এ ৭০’রের দশকের কিছু ছবি প্রকাশিত হলে তা রাতারাতি ভাইরাল হয়ে পড়ে। নজর কাড়ে সমগ্রদেশবাসীর। ছবিগুলোর কমেন্ট বক্সও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে! অনেকেই এই ছবিগুলো রিপোস্ট করেছে কিংবা বিভিন্ন গ্রুপ, পেজ এবং নিজেদের টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে উপরে লিখেছেন, ” ইশশ্ এতযুগ পরেও স্টাইলিশ ফ্যাশনেবল হতে পারলাম না!” , ” রূপ ও মেধার সম্মেলনেই তো নারীর প্রকৃত সৌন্দর্য!” , ” সেই ১৯৬৯ সালের ফটো, অথচ ২০১৯ সালে এসেও আমাদের স্লিভলেস ব্লাউজ পরতে গেলে কত কি ভাবতে হয়!! মানুষ যুগের সাথে আধুনিক হয়, আর আমাদের মন-মানসিকতা যুগের সাথে নোংরা হয়!”
তবে একটা কথা না বললেই নয়! তখনকার যুগের ফ্যাশন সচেতন সাহসী ডিজাইনার ও মডেলেরা এদশকের ছেলেমেয়েদেরও হার মানবে! তাইতো এই স্বর্ণালী যুগকে বাঙালি ফ্যাশনের রেনেসাঁস বলা যেতেই পারে!
Writer Information :
Tazim Sultana Nandita
Ahsanullah University of Science and Technology (AUST)
Dep. of Textile Engineering
2nd year 1st semester