ইকরের তলে তলে ভিকমতির ছানি,
কোন দেশে দেখিয়াছ গাছের আগায় পানি?
জ্বি, নারিকেল এর কথাই বলছি। নারিকেল কিন্তু আজ শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়, বরং এটি একটি দেশের অর্থনীতির উন্নয়নেও বিরাট ভূমিকা পালন করছে। নারিকেলের বাহিরের অংশের “ছোবড়া” যাকে উচ্ছিষ্ট হিসেবে ব্যবহার করা হতো, সেটা থেকে ফাইবার তৈরি করা হচ্ছে। তা থেকে বানানো হচ্ছে নিত্য ব্যবহার্য নানান পণ্য। প্রাকৃতিক উৎস থেকে সরাসরি পাওয়া যায় বলে এটিকে ন্যাচারাল ফাইবার বলা হয়ে থাকে। মূলত এটি কয়ার ফাইবার নামে পরিচিত।
কয়ার শব্দটি দ্রাবিড় শব্দ Kayar থেকে এসেছে যা অর্থ দড়ি। আদিকালে নারিকেল থেকে জাহাজের দড়ি বানানো হতো, তারই পরিবর্তিত রূপ হলো এই কয়ার ফাইবার।
বর্তমান বিশ্বে প্রায় ২,৫০,০০০ টন কয়ার ফাইবার উৎপাদন করা হয় যার প্রায় ৬০ শতাংশ আসে ভারতবর্ষ এবং ৩৬ শতাংশ আসে শ্রীলংকা থেকে। অর্থাৎ কয়ার ফাইবারের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই পূর্ণ করে থাকে এই দু’টি দেশ। এই প্রতিযোগীতায় তাল মেলাতে বাংলাদেশও নারিকেল বা কয়ার ফাইবার তৈরী করছে। ন্যাচারাল ফাইবার নামের প্রতিষ্ঠানটি বাগেরহাট ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) শিল্পনগরীতে অবস্থিত। এখান থেকে তৈরী করা হচ্ছে কয়ার ফিল্ট যা ম্যাট্রেসের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। দেশের বাহিরেও এই ফাইবার রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হচ্ছে।
কয়ার বা নারিকেল ফাইবার মূলত দুই প্রকার হয়ে থাকে:
১। ব্রাউন ফাইবার
২। হোয়াইট ফাইবার
ব্রাউন ফাইবার মূলত পরিপক্ব নারিকেল থেকে পাওয়া যায়। সেজন্য এগুলি বেশ মজবুত, শক্তিশালী এবং ঘর্ষণ প্রতিরোধী হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে হোয়াইট ফাইবারগুলো অপরিণত নারিকেল থেকে পাওয়া যায় যেগুলো তুলনামূলক কম শক্তিশালী, মসৃণ এবং সূক্ষ্ম হয়ে থাকে।
নারিকেলের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ছোবড়া ৩৮% থাকে। এ থেকেই ্মূলত এই ফাইবারটি তৈরী করা হয়। বাকী অংশগুলো , শাস (৩০%) , মালা (১৪%) এবং পানি (১৮%) দিয়ে অন্যান্য কাজ করা হয়ে থাকে।
নারিকেল বা কয়ার ফাইবারের কিছু বাণিজ্যিক নাম রয়েছে:
১। ব্রিস্টাল ফাইবার বা দীর্ঘ ফাইবার
২। ম্যাট্রেস ফাইবার বা ক্ষুদ্র ফাইবার
৩। ডিকর্ডিকেটেড ফাইবার বা মিক্সড ফাইবার।
কয়ার ফাইবার তৈরী হয় একটি নিরাময় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ছোবড়াগুলো এমন পরিবেশে রাখা হয় যাতে করে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হওয়া জীবাণুগুলোকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে পারে।
এই সময় জীবাণুগুলো আংশিকভাবে নারিকেল ছোবড়ার কুঁচির মণ্ডকে পচিয়ে দেয়, যা এটিকে কয়ার ফাইবার ও অবশিষ্টাংশসহ আলাদা হতে সাহায্য করে যা “কয়ার পিথ” নামে পরিচিত। পাকা এবং কাঁচা উভয় অবস্থায়ই নারিকেলের খোসা পঁচানো হয়। পাকা নারিকেলের খোসা পঁচাতে ব্যবহার করা হয় পরিষ্কার পানি। এটি সাধারণত ৬ মাস চুবিয়ে রাখতে হয় জমাটবদ্ধ জলাশয় এর পানিতে। অনুরুপভাবে কাঁচা নারিকেলের খোসা পঁচানোর কাজে ব্যবহৃত হয় লবণাক্ত পানি যেমনঃ সমুদ্রের পানি অথবা স্যালাইনের পরিষ্কার পানি। এক্ষেত্রে সময় লাগে ৪ মাস। পরবর্তীতে নানা প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয় ফাইবারটি।
ব্যবহারঃ
১. লাল কয়ার ফ্লোর ম্যাটস, ডোরম্যাটস, ম্যাট্রেস,ব্রাশ, জাজিম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
২. কয়ার ফাইবার কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
৩. ইউরোপে অটোমোবাইল ইন্ড্রাস্ট্রিতে এর ব্যবহার রয়েছে।
৪. সাদা কয়ার ফাইবার দিয়ে ব্রাশ,দড়ি, মাছ ধরার জাল তৈরি করা হয়।
৫. বাদামি কয়ার ব্যবহার করে প্যাডিং,স্যাকিং এবং হর্টিকালচার করা হয়।
৬. সোফা,ব্যাগ,পাখা এবং নারিকেলের মালা দিয়ে বোতাম,বাসন তৈরি করা হয়।
৭. কুটির শিল্পের সৌখিন পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
৮. হুক্কা তৈরিতেও এর ব্যবহার রয়েছে।
৯. পানিতে সহজে পঁচে না বলে দড়ি ও জাহাজের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়।
১০. বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনা তৈরীতে ব্যবহার করা হয়।
কয়ার প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব ফাইবার। এর দ্বারা পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। সুতরাং কয়ার ফাইবারের ব্যবহার বিশ্বে আরও অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করলে পৃথিবী রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
লেখকঃ
-নাজিফা তাবাসসুম
-জোবায়ের হাসান মুন
-ফাহিম বিন রহমান সৌরভ
ডিপার্টমেন্ট অফ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং
সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি