সৃষ্টির শুরু থেকেই মানবজাতি তার বিভিন্ন প্রয়োজনে, বিভিন্ন সময় বয়ন- সংক্রান্ত কাজের সাথে নিজেদেরকে জড়িয়েছে এবং নিজেদের চাহিদা পূরণ করে আজ সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। আর, সেই সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য ধাতব বস্তুর পরিবর্তে যে ফাইবার জায়গা দখল করে নিয়েছে আজকের বিশ্বে তার নাম ডাইনিমা ফাইবার।
উদ্ভাবনঃ সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে ধাতববস্তুর স্থায়িত্ব ও নমনীয়তায় সমস্যার সমাধান থেকেই ৫২ বছর আগে ১৯৬৮ সালে নেদারল্যান্ডসের DSM এর একজন রসায়নবিদ Dr Albert Pennings কতৃক উদ্ভাবিত হয় আল্ট্রা হাই মলিকিউলার ওয়েইট পলি-ইথিলিন(UHMWP) ফাইবার।এটি ১৯৯০ সালে DSM কতৃক বাণিজ্যিক ভাবে উপলব্ধ এবং ১৯৯৯ সালে জাপান কতৃক বিকশিত করা হয়।
এছাড়া Dynema composite fabric (DCF) যা Cuber Fabric( CTF3) নামে পরিচিত, যা উচ্চ মাত্রার নন- ওভেন কম্পজিট ম্যাটারিয়াল এবং এটি ব্যবহৃত হয় উচ্চ শক্তি, কম ওজনের বস্তুতে।
কেভলার ডাইনেমার মতো কিন্তু ডাইনেমাই বিশ্ববাজারে তারস্থান দখলকরে আছে সবচেয়েশক্তিশালী।
বৈশিষ্ট্যঃ ডাইনিমা ফাইবারটি একটি অবিশ্বাস্য ফাইবার যা ইস্পাত থেকে ১৫গুন বেশি শক্তিশালী, ৮ গুন বেশি হালকা। ডাইনিমা ফাইবারের স্পেসিফিক গ্রাভিটি ০.৯৭, যার কারণে এটি পানিতে ভাসতে সক্ষম এবং একই ওজনে ৪৩cN/dtex টেনসাইল শক্তি প্রদর্শন করে।এটি শুধুই ওজনে হালকা ও বস্তুত অবিনাশী নয়, অত্যন্ত তাপ পরিবাহী ও বটে। এই ফাইবার কোমল, রাসায়নিকভাবে জড়, পানিবিকর্ষি এবং UV রশ্মি প্রতিরোধী। শতভাগ বিশুদ্ধ ডাইনিমা ফাইবারের স্থায়িত্ব কাল ৫ বছর। ডাইনিমা ফাইবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর মলিকিউলার চেইন অত্যন্ত লম্বা হওয়ার কারণে এর পলিমার গঠনের মধ্য দিয়ে যে কোনো মানের বল বা ভর সমান ভাবে ছড়িয়ে যেতে সক্ষম, আর এই জন্যই এটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ফাইবার হিসেবে বিবেচিত। ডাইনিমা ফাইবারের অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিতে প্রোটেক্টিভ ক্লথিং তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়।কাপড়ের স্থায়িত্বকাল এবং শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ডেনিম, নিট, অভেন, কম্পোজিট ফেব্রিকের সাথে ডাইনিমার সংমিশ্রণ করা হয় যা কাপড়কে হালকা করে তোলে।
আল্ট্রা হাই মলিকিউলার ওয়েট পলি-ইথিলিন(UHMWPE) পলিওলেফিনের একটি রূপ।
H H ( | | )
(—C—C—)
( | | ) n
H H
ডাইনিমা ফাইবার প্রস্তুত প্রক্রিয়াঃ ডাইনিমা ফাইবার জেল স্পিনিং প্রক্রিয়াতে প্রস্তুত করা হয়। এই স্পিনিং বা অর্ধগলন প্রক্রিয়াকে নিন্মোক্ত ধাপে সম্পন্ন করা যায়ঃ
দ্রবণ প্রস্তুতকরণঃ এই প্রক্রিয়ায় UHMP (আল্ট্রা হাই মোলার পলি-ইথিলিন)কে দ্রাবক এ দ্রবীভূত করা হয়। আর, দ্রাবক হিসেবে পেরাফিন অয়েল, ডিকালাইন,প্যারাফিন ৬,৭ এবং কেরোসিন ও ইমালসিফাইং অয়েল এর মিশ্রণ ও ব্যবহার করা হয়।
স্পিনিং এর গঠনঃ গিয়ার পাম্পের মাধ্যমে স্পিনারেট এর মধ্যে দিয়ে দ্রাবক নিষ্কাশন করা হয় এবং দ্রুত বাতাসে অথবা পানিতে একে ঠান্ডা করা হয়।
দ্রাবক অপসারণঃ জেল স্পিনিং এ দ্রাবক অপসারণের সর্বাধিক ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক উপায়ে শুকানো বা নিষ্কাশন ব্যবহার করা যার মূল উদ্দেশ্য জেল ফাইবারের দ্রাবক অবশিষ্টাংশ গুলো অপসারণ করা। বর্তমানে নিষ্কাশন হিসেবে ট্রাইক্লোরো-ট্রাইফ্লোরো-ইথেন(TTE),ডেকাইন নামক অসম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন,গ্যাসোলিন, উচ্চ কর্মদক্ষতা সম্পন্ন ড্রাগিং ওয়েল এর ধোঁয়া ব্যবহার করা হয়। জেল স্পিনিং এর ক্ষেত্রে দ্রাবক ও নিষ্কাশনের নির্বাচন সরাসরি ফাইবারের প্রসারিত হওয়ার স্থায়িত্বকে প্রভাবিত করে এবং এটি জেল স্পিনিং এর মূল চাবিকাঠি।
প্রসারিত করাঃ স্পান ফিলামেন্ট গুলোর এর অবশিষ্ট দ্রাবক দূর করার জন্য একটি চুলায় স্থানান্তর করা হয় এবং ৫০ গুন বা তারও বেশি পর্যন্ত প্রসারণ করা হয়। উচ্চ প্রসারণের ফলে ভাঁজযুক্ত পলিমার মলিকিউলার চেইন, সোজা চেইনে পরিণত হয় যা ফাইবারের কার্যকারিতা বাড়ানোর মূল চাবিকাঠি।
ব্যবহারঃ ডাইনিমা ফাইবার এমন এক ধরনের আঁশ যা একই ওজনের স্টিলের চেয়ে যথেষ্ট শক্তিশালী। ডাইনিমা বিভিন্ন দড়ি তৈরির পাশাপাশি ওয়েবেবিং ব্যবহার করতে ব্যবহৃত হয়। এটি জেল স্পিনিং প্রক্রিয়াতে উৎপাদিত হয় যেখানে ফাইবারগুলো টানা, উত্তপ্ত, প্রসারিত এবং ঠান্ডা করা হয়। ডাইনিমা মূলত বিভিন্ন শিল্পে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। মিলিটারি, আইন প্রয়োগকারি, বেসামরিক শিল্প ইত্যাদি নানা খাতে ডাইনামিক নামক সিনথেটিক ফাইবার ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, স্লিং ক্লাইটিংয়ের জন্য প্রায়শই ব্যবহৃত ওয়েবিং হলো ডাইনিমা এবং নাইলনের সাথে একটি হাইব্রিড তাঁত।আদর্শ স্লিং উপাদান হলো স্পেকট্রা এবং ডাইনিমা, যা হালকা, নমনীয়, শক্তিশালী এবং টেকসই উভয়। এই উপাদান গুলো থেকে তৈরি স্লিং গুলো সর্বদা সর্বোচ্চ শক্তির জন্য সেলাই করা হয়। এগুলো সূর্য থেকে অতিবেগুনী রস্মির ক্ষতির জন্য আরো প্রতিরোধী। প্রধান নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো নাইলন ওয়েবিং এর চেয়ে কম স্থিতিস্থাপক ও গতিশীল। ডাইনিমা আলপাইন / ট্রেড ড্র এর জন্য দুর্দান্ত। ডাইনিমা কাট প্রতিরোধী গ্লাভস ডি এসএম ডাইনিমা দিয়ে গ্লোভের লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রস্তুতকারক।
অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিতে ডাইনিমাঃ
~ যেকোনো অ্যাপারেলের উদ্দেশ্য থাকে নতুনত্ব তৈরির সাথে সাথে স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করা। ডেনিম এর ক্ষেত্রে কটন এর সাথে ডাইনিমার মিশ্রণ জিন্স এর স্থায়িত্ব ও আরামদায়কতা কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়।
~ফুড প্রসেসিং, অটোমোটিভ ও স্টিল মেটাল ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহারের জন্য ডাইনিমা থেকে কর্তন প্রতিরোধী নিটেড গ্লাভস তৈরি করা হয়।
~অ্যাথলেট ফুটওয়ার তৈরিতে রাশ্চেল নিট ফেব্রিক এর সাথে ডাইনিমা ব্যবহার করা হয়।
~ডাইনিমা কটনের সাথে ব্লেন্ড করে টেকনিক্যাল ওভেন ফেব্রিক,অ্যাপারেল এ ব্যবহার করা হয়। ডাইনিমা ওয়ার্প,ওয়েফট অথবা দুই দিকের ইয়ার্ন এই ব্যবহার করা হয়।
~ পিওর কার্বন এবং ডাইনিমা এর মিশ্রণ এ হাইব্রিড ফাইবার তৈরি হয় যা কার্বন এর বল প্রতিরোধ ক্ষমতা কে ৫০%-১০০% পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।
অন্যান্য সেক্টরে ডাইনিমার ব্যবহারঃ ক্লাইম্বিং রোপ, হাইকিং ব্যাগপ্যাক, এক্সট্রিম স্পোর্টস ওয়ার, প্যারাসুট ও পেরাগ্লাইড এবং তাবু তৈরিতে ডাইনিমা ব্যবহৃত হয়। ইমার্জেন্সি জ্যাকেট, পুলিশদের দেহরক্ষী বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট তৈরিতে, স্কি এবং স্নোবার্ড তৈরিতে,PVC তৈরি দরজা ও জানালায় ও আজকাল ডাইনিমা ব্যবহৃত হচ্ছে।
ডাইনিমা শিল্পের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে ও এর ব্যাবহার ও চাহিদা টেক্সাইলখাত সহ অন্যান্য খাতকে আরো ফলপ্রসূ করবে বলে আশা করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ
Weavertextile
Wikipedia
howstaffworks
CompositesWorld
Fazilatunnesa Emi
Batch-14( Ctec)