লাল বেনারসি বোধহয় প্রতিটা মেয়ের গোপন স্বপ্ন। বিয়ের পিঁড়িতে কনেকে লাল বেনারসি ছাড়া কল্পনা করা যায় না।শুধু বিয়ের পিঁড়িতে নয়, বেশিরভাগ জমকালো অনুষ্ঠানেই নারীদের দেখতে পাওয়া যায় রং বেরংয়ের বেনারসিতে।বেনারসি প্রতিটা নারীর জীবনের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে। যে বেনারসি শাড়িটি পড়ে নিজেকে উজ্জ্বল করে তুলছেন অথবা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক মুহূর্তের জন্য সেজে বসেছেন,চলুন আজ সেই শাড়িটির সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক।
ইতিহাস :
শোনা যায় বেনারসি শাড়ির উৎপত্তিস্থল ভারতের বেনারস শহর। এই শাড়ি মানবচালিত যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি করা হয়, যার নাম তাঁত এবং যারা তৈরি করে তাদের তাঁতী বলা হয়। বেনারস শহরের বেশিরভাগ তাঁতীই ছিলেন মুসলমান। ঠিক কবে থেকে তাঁরা এই শাড়ি তৈরি করে আসছেন তা জানা যায়নি। যতদূর শোনা যায় তাঁতীদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন আনসারী সম্প্রদায়ের।ইসলাম ধর্মের প্রর্বতক হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যখন মক্কা থেকে মদিনায় যান তখন এই আনসারী সম্প্রদায়ের কাছে আশ্রয় নেন।পরবর্তীতে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এই শাড়ি বেনারস থেকে বাংলায় এলো কিভাবে??
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় বেনারস থেকে প্রায় ৩০০ টি মুসলিম তাঁতী পরিবার চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে।তারা মূলত ঢাকার মিরপুর ও পুরান ঢাকায় বসবাস শুরু করে।তাঁরা তাদের আদি পেশা এই তাঁত শিল্পের কাজ এদেশে এসেও অব্যাহত রাখে।স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্থানীয়রা একাজে যোগদান করলে তা আরও বিস্তৃতি লাভ করে। ক্রমান্বয়ে তাঁতীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কারখানাগুলো পুরান ঢাকা থেকে সরিয়ে মিরপুরে নিয়ে আসা হয়।
বেনারসির একাল-সেকাল:
আমাদের বেনারসির ইতিহাস জামদানীর মতো প্রাচীন না হলেও নারীর ভূষনে এর মর্যাদা অনেক। ঢাকায় বেনারসি শাড়ির মূল কেন্দ্র মিরপুরের বেনারসি পল্লী ।এই শাড়ির আদিস্থান ভারতের বেনারস হলেও এর সঙ্গে ঢাকার ঐতিহ্যের মেলবন্ধন রয়েছে।অন্যদিকে ঢাকার শাড়ির চাকচিক্য ও গুণগত মানে বেনারসকে ছাড়িয়ে গেছে।তাইতো এই শাড়ি ঢাকাই বেনারসি হিসেবে বেশি পরিচিত।কথিত আছে মুম্বাইয়ের বিখ্যাত “দেবদাস” সিনেমার জন্যও বেনারসি শাড়ি নেওয়া হয় মিরপুর থেকে।ঢাকাই বেনারসি তৈরিতে এখন প্রায় এক লাখের বেশি মানুষ জড়িত ।শ্রমিকদের চেষ্টায় বেনারসি একসময় শিল্পে পরিণত হয়।মিরপুর ১০,১১,কালসি,বাউনিয়া বেড়িবাঁধ এলাকায় চলতে থাকে বেনারসি কেন্দ্রিক কর্মকান্ড।এলাকাটি পরিচিতি পায় বেনারসি পল্লী হিসেবে।বেনারসি পল্লীর বস্তির ছোট ছোট খুপরি ঘর অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন ছোট তাঁতে তৈরি হচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত বেনারসি।তাঁত গুলোতে তৈরি হচ্ছে শাড়ি,লেহেঙ্গা, থ্রি-পিস,পাঞ্জাবি।বেনারসি শাড়ি আবার অনেকের কাছে কাতান শাড়ি হিসেবেও পরিচিত।মিরপুরি রেশমি কাতান,দুলহান কাতান, ফুলকলি কাতান,মিলেনিয়াম কাতান,বেনারসি কসমস,ওরগেন্ডি কাতান,প্রিন্স কাতান,রিমঝিম কাতান,টিস্যু কাতান,অপেরা,ফিগা কত যে বাহারী নাম।দামের বহরেও বেশ চওড়া। দাম আড়াই-তিন হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত।নকশা ও মান অনুযায়ী এর নাম ও দাম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো এই বেনারসি এখন মার খাচ্ছে ভারতীয় শাড়ি গুলোর কাছে।হাতে চালিত তাঁত গুলোর তুলনায় অনেক কম খরচে বিদ্যুৎ চালিত তাঁতে তৈরি হচ্ছে বেনারসি, যার কাছে মার খাচ্ছে আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য ঢাকাই বেনারসি। এই প্রক্ষিতে ঢাকাই বেনারসিকে দেওয়া উচিত বিভিন্ন সরকারি – বেসরকারি প্রনোদনা।
জানা গেছে এখানকার তাঁতীদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে এই শিল্পের জন্য কোন জমি না থাকা।এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ভাসানটেকে বেনারসি তাঁতীদের পুর্নবাসনের ঘোষণা দেয়।এর পরিপ্রক্ষিতে তাঁতীরা ভাসানটেকের জমি পেতে তাঁতবোর্ডের মাধ্যমে প্রত্যেকে দশ হাজার করে টাকা জমা দেন।কিন্তু ওই পর্যন্তই,এরপর এই প্রকল্পের আার কোন অগ্রগতি হয়নি।এবিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান ১৯৯৫ সালের জানুয়ারী মাসে ২৪৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে “বেনারসি পল্লী মিরপুর ” নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
সংশোধিত বিনিয়োগ ব্যয় নির্ধারিত করা হয় ২৯৪৭ লাখ টাকা। ২০০২ সালের জুন মাসে জাতীয় গৃহায়ন কতৃপক্ষকে জমির মূল্য পরিশোধ ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রকল্পের ১৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। কিন্তু তাঁতিদের পুর্নবাসন হয়নি। বেনরসি তাঁতকে কেন্দ্র করে দিন দিন সমস্যা বাড়তে থাকায় শ্রমিকরা বেনারসি তৈরি ছেড়ে দিচ্ছেন। ফলে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ছে বেনারসি শিল্প। ২০০০ সালে যেখানে কারিগর ছিলেন ১২০০০ সেখানে এখন ৮০০০ এর ও কম কারিগর আছেন।
বেনারসি শিল্প বাংলাদেশের যেমন গর্ব তেমনি এর সঠিক পরিচর্যা করলে এই শিল্পই হয়ে উঠবে একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত।
উৎস: উইকিপিডিয়া, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
Writers Information:
Snigdha Talukdar
4th year, Batch: 21
Department of Clothing & Textile
Bangladesh Home Economics College