“কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
বলিতে পারি করিলে অনুমতি,
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ।
নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর
ঢাকিতে নাহি হবে।
…
সেদিন হতে চলিল জুতা পরা–
বাঁচিল গোবু রক্ষা পেল ধরা।”
ধুলাবালিতে পরিপূর্ণ এই ধরণী থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য চিন্তিত ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জুতা আবিষ্কার” কবিতায় বিরাজমান রাজা। অর্থাৎ বহুকাল আগে থেকেই রোগজীবাণু, ধুলাবালি এবং ময়লা আবর্জনা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে জুতা পায়ে দিয়ে চলাফেরা করা শুরু করে মানুষ।
কখনো কি ভেবে দেখেছি, চলাচলের জন্য নামিদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিভিন্ন কোয়ালিটির যে জুতা আমরা ব্যবহার করে থাকি সেটি কি আসলেই আমাদের পায়ের জন্য সর্বোপরি আমাদের শরীরের জন্য উপকারী?
জুতা তো আমাদের পায়েই থাকে কি-বা আসে যায় এমন ভাবনা কিন্তু আমাদের অনেকের মনেই থাকে, তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পায়ের উপরে কিন্তু থাকে পুরো শরীরের ভর পায়ের সুস্থতায় তাই সচেতন থাকা খুব বেশি প্রয়োজন। সেই সাথে কিছু পরিধেয় জুতা এমনও আছে যেগুলো একদিকে যেমন পায়ের ত্বকের জন্য ক্ষতিকর ঠিক তেমনি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
বিশ্ব বিখ্যাত কোম্পানি বাটা’র নাম শোনেননি এমন মানুষ হয়তোবা খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। ছোটবেলা থেকেই উৎসব অনুষ্ঠান ঈদ কিংবা পূজা-পার্বণে অল্পবয়স্ক থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষদের দেখা মিলত বাটা কোম্পানির চমৎকার ডিজাইনের আকর্ষণীয় সব জুতা। উন্নত ডিজাইন আর মানসম্মত বিভিন্ন ধরনের জুতা কোম্পানি বর্তমানে প্রচলিত থাকলেও মানুষের কাছে “বাটা” মানেই যেন অন্যরকম আবেগ। তাই বহুকাল থেকে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই কোম্পানির জুতা।
প্রিয় পাঠক বন্ধুরা আমাদের আজকের আর্টিকেলটি গতানুগতিক ডিজাইনের বাটার জুতা সম্পর্কে কিংবা নতুন কোন ফ্যাশনেবল জুতা সম্পর্কেও নয়, বরং অত্যন্ত ভিন্নধর্মী এবং অবাক করার মত একটি জুতা সম্পর্কে। ইতিমধ্যেই পরিবেশবান্ধব জুতা তৈরি নিয়ে বেশ সচেতন হয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জুতা তৈরীর কোম্পানিগুলো। কারণ দিন শেষে পরিবেশে আমাদের জন্য যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনিভাবে এই পরিবেশের সুরক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন। সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সবসময়ই পরিবেশবান্ধব জুতা তৈরির দিকে এগিয়ে আছে। তবে এবার বাংলাদেশেই দেখা মিলছে পরিবেশবান্ধব জুতার। আর সেটি নিয়েই আমাদের আজকের ব্লগ।
ফেলে দেওয়া নানান জিনিস বিশেষ করে প্লাস্টিক সামগ্রী এবং প্লাস্টিকের বোতল পুনর্ব্যবহার করে সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে নতুন এক ধরনের জুতা যেটি মূলত পরিবেশ বান্ধব। অব্যবহৃত জিনিসপত্র ব্যবহার করে সেটিকে টেক্সটাইল পণ্য হিসেবে তৈরি করার কনসেপ্টটিকে মূলত রিসাইক্লিং বলা হয়। এই রিসাইক্লিং পদ্ধতির মাধ্যমে প্রচুর অব্যবহৃত পণ্যকে পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, কিন্তু রিসাইকেল করে প্রস্তুতকৃত পণ্য পরিবেশবান্ধব হবে এটা অনেকটা ভিন্নধর্মী বটে! আর এই ভিন্নধর্মী কাজটি করে দেখিয়েছে বহুজাতিক জুতা প্রস্তুতকারক কোম্পানি “বাটা’।
গত ৫ ই জুন, ২০২১ তারিখ রোজ শনিবার “বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে” এই জুতাটি প্রথম বাজারে আনা হয় বলে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে বাটা কোম্পানি। তাদের ভাষ্যমতে পরিবেশবান্ধব এই জুতার উপরের ভাগ শতভাগ ফেলে দেয়া প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করে তৈরি করা হয়ে থাকে এবং সম্পূর্ণ আরামদায়ক হিসেবে ব্যবহার উপযোগী করার লক্ষ্যে জুতা দিয়ে বাইরের সোলটি ৩০ ভাগ ইথিলিন-ভিনিল অ্যাসিটেট (ইভিএ) থেকে তৈরি করা হয় যা ব্যবহারের ফলে মূলত জুতা নরম এবং রাবারের মতো অনুভূত হয়। এছাড়াও ভেতরের সোলটি তৈরি করতে এক ধরনের নরম কুশন ব্যবহার করা হয়। আর এভাবেই এটি সম্পূর্ণরূপে পরিবেশ বান্ধব এবং আরামদায়ক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। জুতোটি ঠিক কাদের ব্যবহার উপযোগী এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে জানা যায় মূলত আউটডোরে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই জুতাটি বেশি ব্যবহৃত হয় কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে এটিকে ইন্দরে ও ব্যবহার করা যাবে আর জুতাটি ঠিক এভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছে। বাটার এই নতুন উদ্ভাবন ও প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ব্যবসায়ীক অবস্থা নিয়ে দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর কাছে এসব বিষয় উপস্থাপন করেন বাটা’র বিপণন বিভাগের প্রধান ইফতেখার মল্লিক।
যেভাবে রিসাইক্লিং পদ্ধতি সম্পন্ন হয়ঃ
বাটা’র বিপণন বিভাগের প্রধান ইফতেখার মল্লিক বলেন এই রিসাইকেল করার জন্য তাদের একটি প্লান্ট রয়েছে যেখানে মূলত পুনর্ব্যবহারযোগ্য এ সকল উপাদান সংগ্রহ করা হয় এবং সে গুলোকে নির্দিষ্ট কিছু কাঠামো অনুসরণ করে রিসাইকেল করা হয়, আর সব থেকে চমৎকার বিষয় হচ্ছে এই পুরো প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন করা হয়েছে বাংলাদেশে।
ময়লা আবর্জনা এবং অব্যবহৃত ধ্বংসস্তূপের ভিড়ে সুন্দর এই পৃথিবী যখন ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই টেক্সটাইল রিসাইক্লিং আশীর্বাদের ঝুলি নিয়ে চলে আসছে আমাদের সামনে। প্রতিনিয়ত যেভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে এতে করে শুধুমাত্র গাছ লাগিয়ে যে পৃথিবী কে সুস্থ রাখা যাবে সেটা চিন্তা করা অনেকাংশে বোকামি হবে, আর সেটার জন্যই মূলত অব্যবহৃত জিনিসপত্র বিশেষ করে পৃথিবীকে অসুস্থ করে দিতে সক্ষম এ ধরনের প্লাস্টিক সামগ্রী থেকে রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে টেক্সটাইল পণ্যসহ ফ্যাশনেবল বিভিন্ন পণ্য তৈরির উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করাই যুক্তিযুক্ত। বাটার এই উদ্ভাবনী পণ্যটি ব্যবহার করে একদিকে গ্রাহকরা যেমন উপকৃত হবে ঠিক তেমনি পরিবেশ দূষণ ও অনেকাংশে কমে যাবে। বাটা কোম্পানির ছোট-বড় অন্যান্য যেসকল প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা ভবিষ্যতে রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে ইকো ফ্রেন্ডলি পণ্য উৎপাদনের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখবে বলে আশা করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ ঢাকা ট্রিবিউন, বাটা বিডি, টিবিএস নিউজ
লেখকঃ
মোঃ রাশিদ
রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স সোসাইটি