বর্তমানে ছিনতাই বা অপহরণ একটা খুবই পরিচিত শব্দ। আমরা সাধারণত ছিনতাইকারী অথবা অপহরণকারীর কবলে পড়লে সর্বপ্রথম চিন্তা করি আমাদের খবর বা অবস্থান নিকটস্থ স্বজনদের কাছে পৌঁছাতে। যদি অপহরণকারীরা আমাদের মোবাইল ফোন নিয়ে যায় তাহলে সেটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে।
এই সমস্যা সমাধানে চীনের ফুদান ইউনিভার্সিটির একদল বিজ্ঞানী তৈরি করল একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্মার্ট ফেব্রিক যাকে ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে ফেব্রিকও বলা যায় । এটি ব্যবহার করে ব্যবহারকারী তার পোশাকের মাধ্যমেই বার্তা আদান-প্রদান, মানচিত্রের নেভিগেশন ব্যবহার ইত্যাদি কাজ করতে পারবে।
চলুন তাহলে জেনে আসি এই অত্যাধুনিক স্মার্ট ফেব্রিক সম্পর্কে ।
ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে ফেব্রিক এমন একটি ফেব্রিক যেটা ব্যবহার করে ব্যবহারকারীরা তাদের পোশাককে একটি ডিজিটাল স্ক্রিনে পরিণত করতে পারবে। ফলে পোশাকের মাধ্যমেই বার্তা আদান-প্রদান থেকে শুরু করে মানচিত্রের নেভিগেশন ব্যবহার ইত্যাদি কাজ করতে পারবে। এই অত্যাধুনিক ফেব্রিকটি অত্যন্ত টেকসই, নমনীয় এবং এর মধ্য দিয়ে খুব সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে। ফেব্রিকটি প্রায় একশ বারের বেশি ধোয়ার পরেও এর ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে সিস্টেম এর কোন ক্ষতি হয় না।
সাংহাইয়ের ফুদান ইউনিভার্সিটির পলিমার বিজ্ঞানী ‘পেইনিং চেন’ এবং ‘হুইসেং পেং’ এর নেতৃত্বে একদল গবেষক ২০ ফুট লম্বা এবং 10 ইঞ্চি চওড়া ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে ফেব্রিক নামে এই ফেব্রিকটি তৈরি করেন । এই ফেব্রিকের ট্রায়াল এবং পরীক্ষার জন্য প্রায় দশ বছর সময় লেগেছে ।
ফেব্রিকটি তৈরি করার জন্য স্বচ্ছ বিদ্যুৎ পরিবাহী ওয়েফ্ট ফাইবার এবং লুমিনিসেন্ট(আলোকিত) ওয়ার্প ফাইবার ব্যবহার করা হয়। এই ওয়েফ্ট এবং ওয়ার্প ফাইবার একসাথে বুনা হলে খুব ছোট ছোট আলোকবিন্দু তৈরি হয়। এর প্রতিটি পয়েন্টে এক একটি করে ফিক্সেল ব্যবহার করা হয়। যা পরবর্তীতে ফেব্রিকটিকে একটি ডিসপ্লে স্ক্রিনে রূপান্তর করতে সাহায্য করে। বিদ্যুৎ পরিবাহী ওয়েফ্ট ফাইবার গুলো প্রায় ৮০০ মাইক্রোন ব্যবধানে লুমিনিসেন্ট(আলোকিত) ওয়ার্প ফাইবারের সাথে মিলিত হয় ।
ট্রায়ালে দেখা গেছে ফেব্রিকটি প্রায় ১০০০ বারের মতো বাঁকানো, চাপ দেয়া এবং ১০০ বারের মতো ধোয়া এবং শুকানোর পরও এর কার্যক্ষমতার কোন ধরনের ক্ষতি হয়নি । এতে খুব সহজেই বায়ু চলাচল করতে পারে ফলে এটি পরিধানে ব্যবহারকারী অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে ।
গবেষকরা ফেব্রিক এর মধ্যে পাওয়ার সাপ্লাই যোগ করতে সৌরশক্তি সম্পন্ন হারভেস্টিং থ্রেড এবং ব্যাটারী-ফাইবার যোগ করেন। ব্যবহারকারীর সাথে ইন্টারঅ্যাকটিভিটি বৃদ্ধির জন্য এই ফেব্রিকে টাচ-সেনসেটিভ ১৬-বোতাম সম্পন্ন একটি কীবোর্ড যুক্ত করা হয়। এই ফেব্রিকে এমন একটি ওয়ারলেস ইলেকট্রনিক্স ব্যবহার করা হয়েছে যার ফলে ব্লুটুথের মাধ্যমে ব্যবহারকারী তার স্মার্টফোনের সাথে এটি সংযোগ দিতে পারবে। ফলে একজন ব্যবহারকারী খুব সহজেই তার পোশাকের হাতায় থাকা কিবোর্ড ব্যবহার করে বার্তা প্রেরণ এবং গ্রহণ করতে পারবে। একজন রাইডার খুব সহজেই মানচিত্রে তার নির্দিষ্ট সময়ের অবস্থান জানতে পারবে।
ফেব্রিকের পরীক্ষায় দেখা যায়, একজন ব্যবহারকারী সফলভাবে তার পোশাকের হাতা থেকে বার্তা প্রেরণ ও গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং একজন সাইকেলিস্ট সফলভাবে একটি মানচিত্র নেভিগেট ককরছেন।
তাছাড়া গবেষকরা আরো জানান এই ফাইবার দিয়ে একজন ইউনিভার্সিটি ছাত্রের শার্টে তার ব্যাজ বুনা হয়, এবং সেটি খুব সহজেই আলোকিত হয় এবং স্পষ্ট ভাবে দেখা যায়।
তাছাড়া মস্তিষ্কের তরঙ্গ গ্রহণের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এটি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। একটি পরীক্ষায় দেখা যায়, একজন স্বেচ্ছাসেবীকে একটি হেডসেট পরানো হলে, হেডসেটটি কম-ফ্রিকোয়েন্সি সম্পন্ন মস্তিষ্কের তরঙ্গ শনাক্ত করে এবং ডিসপ্লে ফেব্রিক এর সাথে যুক্ত থাকা একটি কম্পিউটারে সেই বার্তা প্রেরণ করে তখন ফেব্রিকের ডিসপ্লেতে “RELAX” শব্দটি প্রদর্শিত হয় । আবার যখন হেডসেটটি একটি উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি সম্পন্ন তরঙ্গ শনাক্ত করে তখন ফেব্রিকের ডিসপ্লেতে “ANXIOUS” শব্দটি প্রদর্শিত হয়।
গবেষক দলটি চাপমুক্ত একজন ব্যক্তির উপর পরীক্ষাটি করার পর দেখা গেল ডিসপ্লে ফেব্রিকে “RELAX” শব্দটি প্রদর্শিত হয় এবং একজন কার-রেসিং গেম খেলা ব্যাক্তির উপর পরীক্ষাটি করলে “ANXIOUS” শব্দ প্রদর্শিত হয়।
সম্ভাবনাময় এই ফেব্রিক সরাসরি শরীরে ব্যবহার করলে বিভিন্ন অসুবিধা দেখা দিতে পারে। গবেষকরা চেষ্টা করছেন কিভাবে ফেব্রিক এর প্রয়োজনীয় ভোল্টেজের পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়।
আশা করা যায় ডিসপ্লে ফেব্রিক দ্বারা স্মার্ট পোশাক তৈরি করে তথ্য আদান-প্রদান মানচিত্রের নেভিগেশন এবং ভাষার প্রতিবন্ধকতা দূর করতেও সাহায্য করবে। এটি ব্যবহার করে জটিল মস্তিষ্কের তরঙ্গ গুলো ডিকোড করা যেতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি টেক্সটাইল জগতকে আরো অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যাবে।
লেখক-
মো: রিয়াজ উদ্দিন
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
ডিপার্টমেন্ট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং
ব্যাচ – ৪৩