মৌলিক চাহিদা গুলোর একটি যখন পোশাক তখন বলার অপেক্ষা থাকে না মানব সমাজে এর গুরুত্ব। প্রাচীন কাল থেকে নানা বিবর্তন এর মধ্য দিয়ে যেমন পরিবর্তন এসেছে মানব সভ্যতায় ঠিক তেমনি বিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে পরিবর্তন এসেছে মানুষের চাহিদা তে সেই সাথে পোশাক ব্যাবস্থাতেও। পোশাকের রুচি সে যার যাই হোকনা কেনো,কিন্তু সকলের কাছে নিজের ব্যবহৃত পোশাক যে হতে হবে চমকপ্রদ এতে কমতি রাখতে চাননা কেউই।এই চাহিদা কে গুরুত্ব দিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে নতুন নতুন সব তন্তু,সেই সাথে উদ্ভাবিত হয়েছে হরেক রকমের আধুনিক সব ডিজাইন। একটা সময় ছিলো যখন মানুষের কাছে পোশাক মানে ছিল শুধুই শরীর ঢাকার বস্তু কিন্তু এখন তা পরিণত হয়েছে ফ্যাসনে।ভাবতে অবাক লাগবে যখন আপনি জানতে পারবেন পোশাকে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে প্রযুক্তি, সেই সাথে গবেষণার মাধ্যমে এমন কিছু বস্তু থেকে ফাইবার সংগ্রহ করা হচ্ছে যা কিনা আমরা কখনো চিন্তাই করতে পারিনি। এই ধারাবাহিক নব উদ্ভাবনের একটি অংশ নিয়ে আজকের আলোচনা। ফাইবার জগতে নতুনত্ব এনে দিয়েছে এমন একটি ফাইবার নিয়ে আজকের আলোচ্য বিষয় যা ” স্প্যানন্ডেক্স ফাইবার” হিসেবে পরিচিত।
অর্থগত দিক দিয়ে স্প্যানডেক্স শব্দের অর্থ হলো “প্রসারিত”। দেশ ভেদে মানুষ কাছে ফাইবারটি নানা নামে পরিচিত। যেমন ইউরোপে এটি “ইলাস্টেন” নামেই পরিচিত।তবে বিশ্বব্যাপি এই ফাইবারটি স্প্যানডেক্স বা ইলাস্টেন নামে বেশি পরিচিত।আমাদের দেশেও ফাইবারটি স্প্যানডেক্স নামেই পরিচিত।নামের অর্থ শুনেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন স্প্যানডেক্স ফাইবার মূলত ইলাস্টিক ধরনের ফাইবার। যা কিনা পোশাক পোশাক সহ নানাবিধ গার্মেন্টস সামগ্রী তে ব্যবহার করা হয় পোশাক বা গার্মেন্টস সামগ্রীকে আরামদায়ক করে তোলার জন্য। একটি ফাইবার যখন এত আরামদায়ক গার্মেন্টস সামগ্রী তৈরীর জন্য ব্যবহার করা হয় তখন নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে ফাইবার টির জন্ম কুন্ডলী এবং এর ব্যবহার। এবার তাহলে জানা যাক কাংখিত স্প্যানডেক্স কে নিয়ে।
একটি ফাইবার কে জানতে হলে প্রথমে জানতে হয় একদম প্রাথমিক কি পর্যায় থেকে ফাইবারটি সংগ্রহ বা তৈরী করা হয়। এক্ষেত্রে যদি স্প্যানডেক্স ফাইবারের কথা বলি তাহলে প্রথমেই বলতে হবে ফাইবার টি প্রাকৃতিক ফাইবার নয় বরং এটি সিন্থেটিক ফাইবার বা সহজ ভাবে বললে ম্যান মেড ফাইবার এটি। এই ম্যান মেড স্প্যানডেক্স ফাইবারটি পরিপূর্ণতা লাভের আগে আবার ছোট্ট একটি গল্প আছে এটিকে নিয়ে।টেক্সটাইল বিজ্ঞানী জোসেফ শিভার মানুষের পরিধেয় বস্ত্র গুলোকে আরামদায়ক করার লক্ষ্যে পোশাকে রাবার প্রতিস্থাপনের জন্য একটি ফাইবার আবিষ্কার করার উপরে দৃঢ় ভাবে লেগে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু পরে তিনি ড্যাক্রন নামক পলিইস্টারকে বিষোদন করার জন্য মধ্যবর্তী পদার্থ হিসেবে একটি পদার্থ ব্যবহার করেছিলেন তখনই মূলত আশার আলো দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। এই সাফল্যের পিছু নিয়ে তিনি একটি প্রসারণ ক্ষম ফাইবার তৈরি করেছিল যা কিনা উচ্চ তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। কিন্তু এতেও ফাইবার টি সম্পুর্ণ ব্যবহার যোগ্য হয়ে উঠেনি।এরপর আরো দশ বছরের মতো লেগে গিয়েছিল এটিকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে। প্রধানত চার ভাবে স্প্যানডেক্স ফাইবার কে প্রস্তুত করা হয়। তন্মধ্যে সল্যুশন ড্রাই স্পিনিং পদ্ধতি বা শুকনো ঘুর্ণন পদ্ধতি টিই সারা বিশ্বে অধিক ভাবে ব্যবহার করা হয়।
এ পদ্ধতিতে প্রি-পলিমার উৎপাদন করা হয় সর্বপ্রথমে। এটি ম্যাক্রোগ্লাইকোল নামক মিশ্রণে মিশ্রিত করে একটি ডায়োসোক্যানেট মনোমারের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীতে যৌগ দুটি একটি পাত্রে মিশ্রিত অবস্থায় রাখা হয়।মিশ্রিত প্রিপোলিমারে সমান পরিমাণ ডায়ামিন দিলে তা প্রতিক্রিয়া জানায়।এখন দ্রবণটি উৎপাদনের জন্য প্রাপ্ত ফলাফলটি একটি নির্দিষ্ট দ্রাবক দিয়ে মিশ্রিত করা হয়।ব্যবহৃত দ্রাবকটি মিশ্রণটিকে আরও হালকা করে। মিশ্রনটিকে একটি নলাকার স্পিনিং সেলে পাম্প করা হয এবং তারপরে প্রাথমিক ফাইবার উৎপাদিত হয়।পরবর্তীতে পলিমার দ্রবণটি একটি স্পিনেরেট নামক ধাতব প্লেটের মাধ্যমে বের করা হয় ফলে তরলগুলো পলিমারের স্ট্র্যান্ডগুলিতে স্থাপিত হয় এরপর স্ট্র্যান্ডগুলি সেলের মধ্য দিয়ে চালনা করার সাথে সাথে তা নাইট্রোজেন এবং দ্রাবক গ্যাসের উপস্থিতিতে উত্তপ্ত হয়। এই প্রক্রিয়াটির ফলে তরল পলিমার রাসায়নিকভাবে প্রতিক্রিয়া ঘটায় সেই সাথে শক্ত স্ট্র্যান্ড এ পরিণত হয়। এরপর ফাইবারগুলিকে একটি ফিনিশিং এজেন্টের সাথে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।এবার তন্তুগুলি একটি স্পুলে রোলারের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয় এবং কাংখিত স্প্যানডেক্স ফাইবার পাওয়া যায়।
এতক্ষন জানছিলাম স্প্যানডেক্স ফাইবার প্রস্তুতির কিছু সংক্ষিপ্ত প্রণালি। এবার এই ফাইবারের ব্যবহারিক দিক নিয়ে কিছুটা ধারনা নেয়া যাক।আমরা দৈনন্দিন যা যা পরিধান করে থাকি বা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করে থাকি সেসবের মধ্যে এমন অনেক কাপড় বা গার্মেন্টস প্রকরন আছে যেখানে স্প্যানডেক্স ফাইবার ব্যবহার করা হয়। উল্লেখযোগ্য ভাবে ব্যবহার করা হয় সাঁতারের স্যুট,পুরুষ বা নারীর ফিটনেস প্রশিক্ষণ এর পোষাক,শর্টস,সামরিক বা গোয়েন্দা বাহিনী তে। এছাড়াও এর সুবিধা গুনের কারণে কার্পেট, গাড়ির অংশ,বিভিন্ন কোম্পানির প্রযুক্তিমূলক পোশাক সহ আরো অনেক কিছুতেই এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে শার্ট, প্যান্ট এমনকি জুতোতেও স্প্যানডেক্স ফাইবারের মিশ্রণ ব্যবহার করে পণ্য প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এ ফাইবারের তৈরী পণ্যের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। তবে ব্যয়বহুল হওয়ায় তৃণমূল পর্যায়ে কিছুটা স্থবির হয়েই চলছে এর এগিয়ে চলা।
লেখক:
মুনতাসির রহমান
Department Of Textile Engineering
Batch:201
BGMEA UNIVERSITY OF FASHION AND TECHNOLOGY