“John Wick” কে নিশ্চই আমরা অনেকেই চিনি..! এই কোয়ারেন্টাইনে থেকেও “John Wick”এর সিজনগুলো দেখেনি এমন মানুষ খুব কমই আছে। এখানে এই ব্যক্তি বুলেটপ্রুফ পোষাক পরিধান করে দুর্ধর্ষ সব প্রফেশনাল কিলার দের সাথে লড়াই করে। অনেক শক্তিশালী বুলেটও তার ক্ষতি করতে পারেনা। কেন পারেনা এটা নিয়ে ভেবেছেন কি কখনো?
আসলেই বুলেটপ্রুফ ভেস্ট কি? এর কার্য পদ্ধতিই বা কি? আসুন এগুলো নিয়ে একটু জানি….
✅ বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট:
মানবদেহকে টার্গেট করে ছোড়া গুলি থেকে ছুটে আসা বুলেট হতে সুরক্ষা প্রদানের জন্য যে জ্যাকেট ব্যবহৃত হয় তাই মূলত বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট শুধুই যে বুলেট হতে মানবদেহকে রক্ষা করে তা নয়, অনেক ধারালো অস্ত্র যেমন ব্লেড, ছুরি এবং আরো অনেক ধরনের বিপদজনক আঘাত হতে রক্ষা করে মানবদেহকে।
বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট মূলত সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং সিকিউরিটি ফোর্সের সাথে জড়িতদের জন্য।যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকরা যেনো শত্রুদের নিক্ষেপিত গুলি বা কোন প্রকার মারাত্মক আঘাত হতে রক্ষা পায় সে জন্যই মূলত সামরিক বাহিনীর সদস্যরা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিধান করে থাকে। আবার পার্সোনাল সিকিউরিটি ইস্যুতেও অনেকে এটা পরিধান করে।
✅ বুলেটপ্রুফ ভেস্ট এর ইতিহাস:
মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত। এসব যুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য মানুষ চামড়া, ব্রঞ্জ,লোহা ইত্যাদির তৈরী সুরক্ষা বর্ম ব্যবহার করেছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি যোদ্ধাদের জন্য আবিষ্কৃত হয় সহজে বহনযোগ্য ইস্পাতের তৈরি বর্ম, যা আপাদমস্তক সুরক্ষা দিত।তবে এগুলো ছিল খুবই ভারী।
আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে বুলেট ও বারুদের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে বর্মও আধুনিকায়নের ছোঁয়া পায়।তৈরি করা হয় বুলেটপ্রতিরোধী বর্ম যা ‘বুলেটপ্রুফ ভেস্ট’ নামেই অধিক পরিচিত। আধুনিক বুলেটপ্রুফ ভেস্টগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি বর্ম, যা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে ফাইবার গ্লাস, নায়লন ও অ্যালুমিনিয়াম। অবশ্য আধুনিক যুগে সবচেয়ে কার্যকর বুলেটপ্রতিরোধী বর্মগুলো তৈরি হয় কেভলার নামক একধরনের ফাইবার(তন্তু) দিয়ে।
✅ বুলেট প্রতিরোধী ফাইবার আবিষ্কার এবং বৈশিষ্ট্য :
ইস্পাতের চেয়েও প্রায় পাঁচগুণ বেশি শক্তিশালী কেভলার ফাইবার ব্যবহৃত হয় বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটে।
বর্মে ব্যবহৃত সিনথেটিক ফাইবার বা “কেভলার” এর আবিষ্কারক যুক্তরাষ্ট্রের রসায়নবিদ “স্টেফানি কোলেক”। যুক্তরাষ্ট্রের ডুপন্ট কোম্পানিতে কাজ করতেন তিনি।১৯৬৫ সালে তিনি স্টিলের চেয়েও মজবুত কেভলার নামের সিনথেটিক ফাইবার বা তন্তু আবিষ্কার করেন যার সম্প্রসারণ ক্ষমতা অনেক বেশি। সম্প্রসারন ক্ষমতা মাপার নীতি হচ্ছে ‘মেগা প্যাসকেল ‘ (Mega Pascal বা MPa)। বুলেট নিরোধক বর্ম হিসেবে পলি আমাইড তন্তু “কেভলার” নামক হাল্কা অথচ মজবুত এই এই ফাইবার এখন ব্যবহৃত হয়।
✅ বুলেটপ্রুফ ভেস্ট এ ব্যবহৃত এই ফাইবারের বৈশিষ্ট্য :
✔কেভলার এর সম্প্রসারণক্ষমতা স্টীলের চেয়ে ৪/৫ গুন বেশি।
✔এই ফাইবারের টেনসাইল স্ট্রেন্থ বেশি। এর টেনসাইল স্ট্রেন্থ ২৮০০ MPa
✔কেভলার ফাইবারে আগুন প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
✔এরা তাপ সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করে।
✔এই ফাইবারের তৈরী বডি আর্মর বেশ পাতলা এবং ওজনে হালকা।
✔যেকোনো আবহাওয়ায় সহযে পরিধানযোগ্য।
প্রাথমিকভাবে গাড়ির টায়ারে ব্যবহারের জন্য কেভলার আবিষ্কার করা হলেও পরে তা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এর অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। আধুনিককালের হালকা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট তাঁরই আবিষ্কারের ফল।
বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ছাড়াও পরবর্তীতে বিমান, মোবাইল ফোন, নৌকাসহ বিভিন্ন জিনিসে কেভলার ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
✅ বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটের গঠন :
এতে কেভলার নামের খুব শক্ত তন্তু থাকে, কেভলার তন্তুগুলোর দুই দিকে থাকে রেজিন প্লাস্টিকের পাত।তন্তুগুলো অনেক ঘন করে প্যাচানো থাকে যাতে এরা বেশ দৃঢ় হয় এবং বুলেটের আঘাত আটকে ফেলতে পারে।বাড়তি সুরক্ষা হিসেবে এর সাথে সিরামিক প্লেট যুক্ত করা হয় যা বোরণ/সিলিকন কার্বাইডের তৈরি হালকা কিন্তু খুবই শক্ত একধরনের ব্যালাস্টিক প্লেট। এছাড়াও বুলেটপ্রুফ ভেস্ট তৈরী করতে বায়োস্টিল ব্যবহৃত হয় যা স্টিলের চেয়ে প্রায় ২০ গুন শক্ত। আবার অনেকক্ষেত্রে কার্বন ন্যানোটিউবও ব্যবহার করা হতে পারে।
✅ বুলেট প্রতিরোধ পদ্ধতি :
শত্রুর গুলি থেকে বের হওয়া বুলেট কিভাবে জ্যাকেটে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং আঘাত থেকে বাচায় এমন প্রশ্ন নিশ্চয় আসতেই পারে!!
আমরা ফুটবল খেলায় রোনালদোর দুর্দান্ত গতির শটে গোল হতে দেখেছি! ফুটবল তীব্র বেগে গোলপোস্টের নেটে আঘাত করে।কিন্তু ঐ জায়গাটা ছিড়ে যায়না কেন?
যদিও ফুটবল হিট করে জালের একটিমাত্র অংশে কিন্তু গোলবারের নেট পুরো শক্তিটা শুষে নেয়।
অনুরূপ ঘটনাই ঘটে কেভলার ভেস্ট এর ক্ষেত্রে।বুলেট হিট করার পর বুলেটের শক্তি শোষণ করে নেয় কেভলার ফাইবার।ফলে বুলেট সেটি ভেদ করতে পারে না।
এটা তো গেল বুলেটটি জ্যাকেটকে ভেদ না করার কথা। কিন্তু বুলেটটি যখন প্রচণ্ড বেগে এসে শরীরে আঘাত করে তখন এরকম মনে হবে যেন কেউ অনেক ওজনের হাতুরি দিয়ে সজোরে আঘাত করেছে। আর এমন হলে অবশ্যই মারাত্নকভাবে আহত হবার কথা?
তাহলে কেন ব্যবহারকারী আহত হবেন না??
এই সমস্যা থেকে পরিত্রানের জন্য জ্যাকেটগুলো “সিরামিক ব্যালাস্টিক” প্লেট দিয়ে এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন বুলেটটা যে জায়গায় আঘাত করে শুধু সেই জায়গার না, বরং পুরো জ্যাকেটের তন্তুগুলোই বুলেটের গতিশিক্তিকে শোষণ করে নিতে পারে। তাই আঘাতের প্রভাবটা শুধু এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে জ্যাকেটের সকল জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যবহারকারী আর আগের মত ব্যথা পায়না।
বুলেটটা যখন এসে জ্যাকেটে আঘাত করে এবং আটকে যায় তখন বুলেটের মাথাটা চ্যাপ্টা হয়ে যায়।কাদার একটা বলকে ওয়ালে ছুড়ে দিলে তা যেমন চ্যাপ্টা হয়ে যায় অনেকটা তেমন। এ ঘটনাকে বলা হয় মাশরুমিং। এক একটা টাইপের জ্যাকেটের ক্ষমতা এক এক রকম হয়। কোনটা বেশি ডায়ামিটারের বুলেটকে আটকাতে পারে, কোনটা কম। ওজনের দিকেও খেয়াল রাখতে হয় যেন পরে নড়াচড়া করতে কষ্ট না হয়।
তবে আমাদের পাশের দেশের ব্যবহৃত বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটে ৭.৬২*৩৯ মি.মি বুলেটের আঘাতেই সৈনিকদের নিহত হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। পরের পর্বে এর ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
✅ কেভলার ফাইবারের তৈরী কয়েকধরনের জ্যাকেট রয়েছে:
👉BALLISTIC Protection : এগুলো বন্দুক বা পিস্তলের বুলেট প্রতিরোধ করে থাকে।
👉EDGED BLADE Protection : এগুলো ধারালো অস্ত্র যেমন ছুরি, তলোয়ার ইত্যাদির আঘাত থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
👉SPIKE Protection: সূক্ষ্ম-সূচালো অস্ত্র থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
👉Multi Thread Armour: উপরের সকল কোয়ালিটি বিদ্যমান থাকে এসকল জ্যাকেটে।
✅ বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ব্যাবহার সমূহ :
👉যুদ্ধক্ষেত্রে আত্নরক্ষায় সবথেকে বেশি ব্যবহৃত হয়।
👉সামরিক বাহিনীর সৈন্যদের সুরক্ষা প্রদান করতে ব্যবহৃত হয়।
👉সিকিউরিটি ইস্যুতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
👉রাষ্ট্রনেতাদের সুরক্ষা প্রদানে ব্যবহৃত হয়।
👉সিকিউরিটি গার্ড, বডিগার্ড, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের জন্য ব্যবহৃত হয়।
👉বড় বড় অপরাধীদেরকে জনসমাগমের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তার সুরক্ষায় ব্যবহৃত হয়।
👉দায়িত্বরত সংবাদকর্মীরা দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় ব্যবহার করে।
সর্বোপরি শত্রুর নিক্ষিপ্ত গুলি থেকে আত্নরক্ষার্থে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট বা কেভলার ফাইবার এক কথায় অনবদ্য!!
(দ্বিতীয় পর্ব আসছে শীঘ্রই..)
🏷 তথ্যসূত্র: Wikipedia, সামরিকবিষয়.কম, bodyarmour.com,millitarynews, পরিবেশ ডট কম
🗒 Writer Information :
Md Rashid
Research Assistant-Textile Engineers
Dept of FE (1st Batch)
Dr. M A Wazed Miah Textile Engineering College