ঐতিহ্যের কিনারা করার সাধ্য আমাদের নেই,তবে রয়েছে ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষমতা, আছে সকল সম্ভাবনাকে বাস্তব রূপে সজ্জিত করে ঐতিহ্যের নব দিগন্ত উম্মচনের ক্ষমতা। আমরা যে ঐতিহ্যগত ভাবে সমৃদ্ধ একজাতি সে তো সকলেরই জানা। কিন্তু এ ঐতিহ্যের প্রান্তরকে সমৃদ্ধ করার নিমিত্তে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সব ঐতিহ্য। যার কিছুটা রয়ে গিয়েছে চোখের আড়ালে আবার কিছুটা প্রকাশিত হয়েছে মানব সভ্যতার বিস্তৃত প্রান্তরে। আমাদের মূল্যবান সেই সাথে সমৃদ্ধ ঐতিহ্যগুলো হয়তো জেনে ওঠা হয়না ব্যাস্ততা নামক শব্দটির হস্তক্ষেপে। আজ নাহয় ব্যাস্ততা কে আড়াল করে জানি নিজ দেশের একটি পরিচিত ঐতিহ্য কে নিয়ে, জানি উক্ত ঐতিহ্যের নেপথ্যে কাজ করে যাওয়া জাতীয় একটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে। কালক্ষেপণ না করে জানাতে চাই, “বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড” নিয়েই মূলত সাজানো আজকের আলোচ্য বিষয়। দেশের তাঁত শিল্প কে টিয়ে রেখে শিল্পটিতে নবমাত্রা যুক্তর কিছুটা ইতিকাথা তুলে ধরবো আজকের আলোচনায়।
আলোচ্য বিষয় নিয়ে জানতে হলে শুরুতেই বুঝতে হবে তাঁত সম্পর্কে। মূলত বহুল পরিচিত তাঁত হচ্ছে এক ধরনের যন্ত্র ,যে যন্ত্রের সাহায্যে তুলা বা তুলা হতে প্রস্তুতকৃত সুতা থেকে কাপড় তৈরী করা হয়। আবার এই তাঁত এর মাঝেও রকমারিতা বিদ্যমান। এই যেমন খুব ছোট আকারের হাতে বহন যোগ্য তাঁত থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির স্থির তাঁত সহ নানা রকমের তাঁত দেখা যায়। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমান সময়ে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন,আধুনিক বস্ত্র কারখানাগুলোতে বর্তমানে সয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা হয়। তবে এতকিছুর মাঝেও তাঁত শিল্পকে টিকিয়ে রাখার পেছনে রয়েছে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠান তাদের সুদৃঢ় কর্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের অন্যতম ব্রান্ডে পরিণত করেছে তাঁত শিল্প কে। কিংবদন্তি সে প্রতিষ্ঠানটি হলো “বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড”। সেই প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসনামল পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী আজও সমাদৃত বাংলার তাঁত। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশে এবং বিশ্ব চাহিদা মাথায় রেখে দেশের শিল্প খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে ভংগুর অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন “বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড”। পরবর্তীতে বিশেষায়িতভাবে তাঁত শিক্ষা প্রসারে লক্ষে ১৯৮১ সালে প্রথম নরসিংদীতে হস্ত তাঁত ব্যবহারের জন্য একটি পেশাদার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি একক একটি প্রতিষ্ঠান হলেও মূলত এটি পরিচালিত হয় “বাংলাদেশ বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়”হতে। ক্ষুদ্র পরিসরে কাজ শুরু করেও বর্তমানে দেশের লাভজনক খাতগুলোর একটি হচ্ছে তাঁত শিল্প। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান সময়ে তাঁতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁত শিল্পের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটিয়ে সারা দেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি করে তাঁত শিল্পকে অন্যতম হস্তশিল্পের স্থানে উপনিত করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড। বোর্ডের উক্ত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সেই সাথে তাঁত শিল্পের বিস্তারের জন্যও রয়েছে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিক্রিমা।
তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গুলো সংক্ষেপে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। তাঁত শিল্পকে ছড়িয়ে দেবার জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে অভিজ্ঞ ব্যাক্তিদের মাধ্যমে বুনন সেবা প্রদান করা, তাঁত শিল্প নিয়ে কাজ করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গুলোকে তাঁতের সম্প্রসারণ ঘটাতে সহায়তা করা, তাঁতিদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এবং হস্ত চালিত তাঁতে কাপড় উৎপাদন সেই সাথে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে তাঁত বুননে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা, তাঁতীদের কর্মসংস্থান এর লক্ষ্যে মূলধন প্রদান করার মত যুগান্তকারী প
দক্ষেপের মাধ্যমে তাঁত শিল্পকে নতুন রূপ প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে তাঁত বোর্ড।
তাঁত বোর্ড তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি কিছু নিয়মিত কার্য পরিচালনা করে যাচ্ছে। তাঁত কারিগরদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয়,তাঁতিগণকে প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদান করার পাশাপাশি কাঁচামাল ন্যায্যমূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করা, তাঁত পণ্যর জনপ্রিয়তা বৃষ্টির লক্ষ্যে পণ্যের সুষ্ঠু ব্রান্ডিং করার মত অনেক কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে থাকে তাঁত বোর্ড।
দেশে তাঁত শিল্প প্রচার ও প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে তাঁত বোর্ড দক্ষতার সাথে অনেক প্রকল্প পরিচালনা করে তা বাস্তবে রূপ দিয়েছে,যার কর্মফল ভোগ করছে দেশের তাঁতি সমাজ।সেই সাথে ভবিষ্যতে তাঁত শিল্পে ব্যাপক উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমান সময়েও তাঁত বোর্ড কিছু কার্যপদ্ধতি গ্রহন করেছেন। “বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ” এর ওয়েবসাইট এর সহয়তায় অতীত থেকে বর্তমানে বাস্তবায়িত হওয়া এবং প্রক্রিয়াধীন কিছু কার্যপরিকল্পনা তুলে ধরছি।বাস্তবায়িত হয়েছে এমন কিছু প্রকল্প হলো, সিলেটে বসবাসরত উপজাতী মনিপুরীদের তাঁত শিল্পের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদান করা , তাঁতে প্রস্তুতকৃত পোশাকের উন্নয়ন করে দেশে তাঁত বস্ত্র প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা,উত্তরের প্রাচীন জেলা এবং বিভাগীয় শহর রংপুরে তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা এবং তাঁতিদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি গ্রহন ই মূলত অতীতে গ্রহন করা পদক্ষেপ গুলোর মধ্যে সফলতম কার্যপদ্ধতি।
এবার জানা যাক বর্তমান সময়ে প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় থাকা কিছু কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে।বাংলাদেশের সোনালী ঐতিহ্য “মসলিন” তৈরির প্রযুক্তি পুনরুদ্ধার করা, শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি স্থাপন, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের ৫টি বেসিক সেন্টারে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ, দেশে ১টি ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউট ও ২টি বাজারজাতকরণ কেন্দ্র স্থাপন, বন্ধ থাকা তাঁতকল গুলোতে পুনরায় কাজের গতি দান করা এবং জামালপুরে “শেখ হাসিনা নকশি পল্লি স্থাপন করা সহ আরো কিছু প্রকল্প কার্যাধীন রয়েছে। বাস্তবায়ন হওয়া এবং প্রক্রিয়াধীন থাকা কার্যপরিকপ্লনা গুলো সফল ভাবে বাস্তব রূপ পেয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে দেশের তাঁত শিল্পকে এটিই প্রত্যাশা সকলের।
দেশে বেকারত্বে দূরিকরনের পাশাপাশি দক্ষ জনবল তৈরী করে দেশের কর্মক্ষম মানুষকে মানব সম্পদে রূপান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড দেশের নানা স্থানে চারটি তাঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা করে।প্রতিষ্ঠান গুলো হচ্ছে:
★বাংলাদেশ তাঁত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, নরসিংদী।
★তাঁত প্রশিক্ষণ উপকেন্দ্র, বেড়া, পাবনা।
★সিলেট মনিপুরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
★রংপুর তাঁত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
দেশীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে আমাদের প্রত্যকের উচিত দেশের ঐতিহ্যবাহী ” তাঁত ” শিল্পকে নিয়ে জানা। আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য তাঁতকে বিশ্ব দুয়ারে কৃতিত্বের সাথে পৌঁছে দিয়ে দেশের শীর উঁচু করছে জাতীয় প্রতিষ্ঠান “বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড”। সেই সাথে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই নিভৃতে কাজ করা দেশের তাঁতি সমাজকে, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তাঁত আজ পরিণত হয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যে।
তথ্যসূত্র : bhb.gov.bd
Writer information:
মুনতাসির রহমান
Department Of Textile Engineering
Batch:201
BGMEA UNIVERSITY OF FASHION AND TECHNOLOGY