প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। অপার সৌন্দর্যের আধার চারিদিকে বিস্তৃত। প্রকৃতির নিয়মেই আসে পরপর ছয়টি ঋতু। প্রকৃতি প্রতি নিয়ত নব নব রুপে সেজে উঠে। প্রকৃতির রূপ বদলের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এই দেশের সংস্কৃতির এই দেশের মানুষের পোশাকের।
মানুষের আত্মপরিচয়ের বিধৃত রূপই হচ্ছে সংস্কৃতি। এ পরিচয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনযাত্রা। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতি-ব্যাখ্যা এক্ষেত্রে স্মরণীয়, “সংস্কৃতি মানে সুন্দরভাবে, বিচিত্রভাবে বাঁচা, প্রকৃতি-সংসার ও মানব সংসারের মধ্যে অসংখ্য অনুভূতির শিকড় চালিয়ে দিয়ে বিচিত্র রস টেনে নিয়ে বাঁচা, নর-নারীর বিচিত্র সুখ-দুঃখে বাঁচা, বিচিত্র দেশ ও বিচিত্র জাতির অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে বাঁচা, প্রচুরভাবে, গভীরভাবে বাঁচা, বিশ্বের বুকে বুক মিলিয়ে বাঁচা।”
যার কারনে বছরের শুরুতেই মানুষের মনেএকটা অন্য রকম অনুভুতি কাজ করে। যার কারনে বাঙালী নির্বিশেষে অসম্প্রদায়িক চেতনায় একত্রিত হয়। সকলে মিলে একত্রিত হয় এই বিশেষ দিনটিতে।পালন করে প্রহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশের মানুষের সর্বজনীন উৎসব। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। এসকলে সকলকে শুভেচছা জানাই।এইদিন সব পোশাক ও থাকে একরকম। ছোট বড়,ধনী-দরিদ্র কোনো ভেদাভেদ নেই।সকল নারীর অঙ্গেই থাকে সাদা শাড়ি লাল পাড়।মনে হয় যেনো কাশফুলের মেলা বসেছে।তেমনি ছেলেও পড়ে লাল বা সাদা পাঞ্জাবি। ছেলে বুড়ো ছোট বাচ্চা সবাই একই ভাবে সজ্জিত হয়।এইদিনটি শুরু হয় পানতা ভাত আর ইলিশ মাছ দিয়ে।বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল হালখাতা ও গ্রামীণ বৈশাখী মেলা। বাংলা নববর্ষ শুধু একটি লোকজ সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, এর অর্থনৈতিক তাৎপর্য ছিল বিরাট। যার দরুন নতুন মাত্রা যোগ হয় তাদের পোশাকেও।যা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য।
পোশাকের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তার পরিচয় তুলে ধরতে পারে।যার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে বাঙালির রূপ রস গন্ধ। আজও ঢাকায়ই জামদানী শাড়ি পৃথিবী বিখ্যাত। সারা পৃথিবী জুড়ে তা সমাদৃত। হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য বাঙালি এখনো ধারন করে আছে। মসলিন কাপড়ের কথা পৃথিবী পৃথিবীবাসি আজও ভুলতে পারেনি। বাঙালি জাতি যার জন্য প্রাণ দিয়েছিলো।সে কাপর আজ পর্যন্ত কোনো জাতি উৎপাদন করতে পারে নি।
বাংলার আর এক জনপ্রিয় উৎসব বসন্ত। বসন্তে চারিদিক যেমন ফুলে ফলে ভরে যাই।গাছে গাছে নতুন কুড়ি গজায়। তখন আনন্দের পুলক লাগে চারিদিক।বাঙালি ও নতুন সাজে সেজে ওঠে। তাদের পোশাক ও থাকে নতুন চমক।প্রকৃতির সৌন্দর্য তারা তাদের পোশাকের মধ্যে তুলে ধরে।প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস এস কিছুই স্থান পাই তার পোশাকের মধ্যে। বাঙালী তার সংস্কৃতিকেই লালন করে বেঁচে আছে আজও।
আমাদের দেশে সকল ধর্মের লোক বাস করে। প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা ধর্মীয় উৎসব। কিন্তুু প্রত্যেকে সকল ধর্মীয় উৎসবকে সম্মান করে। সব উৎসবেই বাঙালী নতুন পোশাক পড়ে। এসকল উৎসবেও বাঙালী উপহার দেয় একে অন্যকে নতুন পোশাক। এতে করে কোনো ভেদাভেদ থাকে না সকলে মিলে এক সাথে ভালোবেসে পালন করে উৎসব।এটাই আমাদের সংস্কৃতির শিক্ষা।
বর্তামানে বাঙালিও প্রতি বছর পালন করে ভালবাসা দিবস। যদিও ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কোনো দিনের প্রয়োজন হয় না।কিন্তু এই বিশেষ দিনটি মানুষ মানুষের জীবনের কাছের মানুষকে শুভেচ্ছা জানাই। মা বাবা, ভাই বন এর প্রতি এক আলাদা অনুভূতি কাজ করে।সকলে মিলে এক আনন্দ ঘন পরিবেশ সৃষ্টি করে।আর অপর দিকে প্রিয় মানুষটির জন্য দিনটি হয় আরো স্পেশাল।এই দিনটি তে পোশাকেও অন্য মাত্রা যোগ হয়।তারা একই রকম পোশাক পরে থাকে সাধারনত।
বাঙালি নয় মাস রক্ত দিয়ে স্বাধীনত
া অর্জন করেছে।যার ইতিহাস সারা পৃথিবীর মানুষ ভুলতে পারে না।অনেক রক্ত আর প্রানের বিনিময়ে অর্জন হয়েছে স্বাধীনতা।যার ফলে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। প্রতি বছর ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মানুষসহ পৃথিবীর বাসি পালন করে। বাঙালি জাতি ভাষার জন্য প্রান দিয়েছে যা পৃথিবীতে আর কোনো জাতি দেয়নি। আজ পৃথিবীর বুকে বাংলা ভাষা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বকৃীত। এই দিন কালো ব্যাচ পরে ১২টা ১মিনিটে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই।এছাড়া ও এই দিনগুলোতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
সংস্কৃতি বিষয়টি গতিশীল প্রক্রিয়া। কোন পরিপূর্ণ চূড়ান্ত বিষয় নয়। সময়ের বিবর্তনে, সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে যেমন শাড়ী বহুল চলিত। আগে অধিকাংশ নারীকে দেখা যেত শাড়ি পড়তে, কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তারাই এখন মেক্সি, কামিজ, স্কার্ট, টি-শার্টে নিজেদের সজ্জিত করছেন।, তবে শাড়ীর কদর এখনো রয়েছে ঐতিহ্য সংস্কৃতি হিসেবে। আবার পূর্বপুরুষেরা ধুতি-পাঞ্জাবিতে, লুঙ্গীতে অভ্যস্ত থাকলেও কালের পরিক্রমায় এখন তাদের অধিকাংশ শার্ট-প্যান্ট, সর্টস বা স্যুট -টাই পড়েন। মানে, সে সময় নারী পুরুষের পোশাক যেমন বাঙালীর সংস্কৃতির অংশ ছিলো,একই ভাবে বর্তমানেও তাদের পোশাক আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ। বাংলাদেশ যেহেতু মুসলিম প্রধান দেশ সেহেতু আমাদের সংস্কৃতিতে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব স্বাভাবিকই ঘটে। পূর্বের নারীরা অধিক পড়তেন আবার অনেকে শাড়ির সাথে বড় চাদর দিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিতেন। এমনই বোরকার প্রচলন থাকলেও ইদানিং অধিক সংখ্যক নারীদের মধ্যে হিজাব পরিধানের প্রবণতা লক্ষণীয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক ও সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময়। কেননা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সংখ্যা প্রায় ৮৯৭৮২৮। আর তারা প্রত্যেকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লালন করে। তাদের পোশাকেও যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যেমন সর্ববৃহৎ উপজাতি চাকমারা কোমর জড়ানো গোড়ালি পর্যন্ত পোশাক পরে যাকে পিনোন বলা হয়। কোমরের উপর অংশকে বলা হয় হাদি। হাদি আর পিনোন সাধারণত রঙবেরঙের বিভিন্ন নকশার হয়। পুরুষরা “সিলুম” নামক গায়ের জামা এবং “টেন্নে হানি” নামক জামা পরিধান করে। এই নকশা প্রথমে আলাম নামে পরিচিত একটুকরো কাপড়ের উপর সেলাই করা হয়।সাঁওতাল নারীরা দুই খন্ড কাপড়ের এক ধরনের পোশাক পরে যাকে বলে ” ফতা “। ত্রিপুরা গোষ্ঠী কাপড় বুননে অনেক পারদর্শী,পুরুষেরা পরিধান করে নিজেদের তৈরি গামছা ও লুঙ্গী। একইভাবে অধিকাংশ গোষ্ঠীরই রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে লালন করছে দিনের পর দিন।
বর্তমানে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে পশ্চিমা পোশাক। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাঙালি নারী-পুরুষরা এখন ফ্যাশন সচেতন হওয়ায় আরামদায়ক, নান্দনিকতা ও ফ্যাশনেবলের দিক বিবেচনা করে পশ্চিমা পোশাক স্কার্ট-টপ,শার্ট-প্যান্ট, টি-শার্ট, জিন্স বেশি ব্যবহার করে। যার ফলে পশ্চিমা পোশাক অনেকাংশে আমাদের সংস্কৃতিকে ত্বরান্বিত করছে।তাই বলে বাঙালি তাদের ঐতিহ্যের ধারক ও সংস্কৃতির লালক তাদের পোশাক শাড়ি, ধুতি,পাঞ্জাবি এগুলো হারিয়ে যেতে দেয়নি। আর না কখনো দিবে না। বাঙালিকে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও পোশাক দ্বারাই অন্যান্যভাবে নির্বাচন করা যায়।
বাঙালির সংস্কৃতি ভেঙ্গে পড়ার নয়,প্রতিনিয়ত গড়ে ওঠার। বাঙালি জাতি এক অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী। এক অসামান্য স্তরে উন্নতি হয় বাঙালি সংস্কৃতির।
তথ্যসূত্রঃ দৈনিক কালের কন্ঠ, roar.media
Writer information:
Nafiza Nizami (batch -201)
Ariana afrin (batch -201)
BGMEA University of Fashion & Technology