Friday, November 22, 2024
Magazine
More
    HomeTechnical Textileপর্ব-০৮ঃ লুঙ্গির একাল-সেকাল।

    [Traditional Textile Series]পর্ব-০৮ঃ লুঙ্গির একাল-সেকাল।


    বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরনো নমুনা ‘চর্যাপদ’। কিন্তু চর্যাপদ থেকে সেকালের নারী ও পুরুষেরা কী ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করতেন সে সম্বন্ধে আমরা কোনো ধারণা পাই না। তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের যেসব ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলক ও পাণ্ডুলিপির চিত্র পাওয়া যায় তা থেকে আমরা তাদের পোশাক সম্বন্ধে কিছুটা জানতে পারি।  তাদের বেশিরভাগ পোশাকই ছিল লজ্জা নিবারণ ও শীত-গ্রীষ্মসহ বিভিন্ন আবহাওয়ার রুক্ষতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দরকারী ন্যূনতম পোশাক। সেজন্যই সে সময়ে নারী-পুরুষের পোশাকে খুব একটা পার্থক্য ছিল না এবং এ যুগের মানুষের মতো রকমারি পোশাকও ছিল না।


    লুঙ্গি মূলত বার্মিজ শব্দ। সাধারণত ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশে লুঙ্গি জনপ্রিয় পোশাক। জানা যায়, দক্ষিণ ভারতের তামিল নাডুতে এর সূচনা ঘটে। আমদের দেশে লুঙ্গি পড়ার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়।কেননা, এদেশে সাধারনত ধূতি আর গামছাই পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বিশ শতকের বিশের দশকে মায়ানমারের রেঙ্গুন থেকে আমদানী করা হত লুঙ্গি। ধূতিকে হিন্দুদের পোষাক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাই সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও সামাজিক কারনে ধূতির প্রতিদ্বন্দ্বী হতে থাকে এই লুঙ্গি। যদিও এ মনোভাব বেশিদিন টিকেনি। এখানকার হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সর্বোপরি সকলের প্রিয় হয়ে উঠে লুঙ্গি। লুঙ্গির চাহিদা বৃদ্ধি পাবার কারণে ছোটো আকারে কিছু কারখানাও গড়ে উঠে এখানে। দেশ বিভাগের পর একসময় পূর্ব বাংলায় লুঙ্গিই হয়ে উঠে জনসাধারণের পোশাক। স্বাধীনতার পর একসময় কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর, দোহার, নবাবগঞ্জ ও শ্রীনগরের হস্তচালিত তাঁতের (হ্যান্ডলুম) তৈরি লুঙ্গি প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রচালিত তাঁতে (পাওয়ারলুম) লুঙ্গি তৈরি শুরু হলে উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েক গুণ। বর্তমানে পাবনা, সিরাগঞ্জের বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর ও কুষ্টিয়ার কুমারখালীর যন্ত্রচালিত তাঁতেই চাহিদার অধিকাংশ লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। সুতির চেক ও প্রিন্টের লুঙ্গির পাশাপাশি কারুকাজ করা জ্যাকেট লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে দেশে। বাংলাদেশে লুঙ্গির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারগুলো হলো নরসিংদীর বাবুরহাটে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ও টাঙ্গাইলের করটিয়ার। এই বাজারগুলো থেকেই দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা লুঙ্গি কিনে থাকেন এবং পরবর্তিতে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে থাকেন। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে লুঙ্গি রপ্তানীও করা হয়।


    লুঙ্গির সূচনা হয় দক্ষিণ ভারতের তামিলনাডুতে। ভেস্তি নামক এক ধরনের পোশাককে লুঙ্গির পূর্বসূরী বলে মনে করেন গবেষকরা। ইতিহাসে উল্লেখিত আছে মসলিন কাপড়ের ভেস্তি পোশাক তামিল থেকে ব্যবিলনে রপ্তানী হত। ব্যবিলনের প্রত্নতাত্বিক নিবন্ধে ‘সিন্ধু’ শব্দ খুঁজে পাওয়া যায়। তামিল ভাষায় সিন্ধু অর্থ কাপড় বা পোশাক। ‘বারাদাভারগাল’ নামের তামিলনাডুর জেলে সম্প্রদায় পশ্চিম আফ্রিকা, ইজিপ্ট বা মিশর এবং মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে লুঙ্গি রপ্তানীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সময়ের সাথে, সাদা কাপড়ে ফুল এবং অন্যান্য নকশা চিত্রিত হয়ে পরবর্তীতে লুঙ্গিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে লুঙ্গি বাংলাদেশ, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোয় বেশি জনপ্রিয়।


    বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে সুতায় নকশা করা, বাটিক করা অথবা সিল্কের লুঙ্গি বিয়ের উপহার হিসেবে বরকে দেওয়া হয়। যদিও এটি শহুরে বিয়ের আয়োজনে খুব একটা চোখে পড়ে না। এছাড়া কোন বিশেষ দিন উপলক্ষে শিক্ষক এবং মসজিদের ইমামদের লুঙ্গি উপহারের রীতি এখনও চালু আছে দেশে। এদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের উপজাতীয় মহিলারাও লুঙ্গির মত দেখতে একই রকম একটি পোশাক পরিধান করেন। বর্তমানে লুঙ্গির ব্যবহার কমে গেলেও একবারেই অস্তিত্বহীন হয়ে যায়নি। এখনো লুঙ্গি পরার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন আমাদের দেশের রিক্সাচালকসহ নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজন। তারা এখনো লুঙ্গির ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। যদিও সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক রিক্সাচালক বা নিম্নবিত্ত মানুষও লুঙ্গির পরিবর্তে প্যান্ট পরছেন। একটা সময় হয়তো লুঙ্গি জায়গা পাবে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে। কোনও এক প্রজন্ম ভুলে যাবে লুঙ্গি নামের এক রহস্যময় আরামদায়ক পোশাকের কথা।


    আরবের লোকেরা ধুতি পরতো লম্বা করে কোচা ছাড়া। পরার ধরন ছিল সেলাইবিহীন লুঙ্গির মতো। পারস্যে এই ধরনের পোশাকের নাম ছিল ‘তাহবন্দ’। বাংলাতে এই শব্দ হয়েছিল ‘তহবন’, ‘তবন’। যদিও এখন ধুতিকে মনে করা হয় হিন্দুদের পরিধেয় পোশাক। কালক্রমে পরনের কৌপিন লম্বা করে পরার রীতি চালু হয়। সেইসঙ্গে কোচার ঝুলও বৃদ্ধি পায়। এই চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি হয় ধুতি। সেকালের মানুষ ধুতি পরতো কাছা দিয়ে। কাছা ছিল ঢিলাঢালা। তবে কর্মজীবী পুরুষ তা পরতো ‘মালকোচা’ দিয়ে। ‘লুঙ্গি’ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা পোশাক তবে নামটা এসেছে ‘বর্মি’ শব্দ থেকে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঙালি মুসলমানদের মাধ্যমে আসা এই শব্দটি ‘তবন’ শব্দটিকে সরিয়ে দিয়েছে। 


    যেসব অঞ্চলে লুঙ্গি জনপ্রিয়ঃ
    ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং শ্রীলঙ্কায় লুঙ্গির প্রচলন বেশি দেখা গেলেও মালদ্বীপ, আফ্রিকার অনেক দেশ, পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ, ক্যারিবীয় অঞ্চল এমনকি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও লুঙ্গি বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও মাদাগাস্কার, মালাউই, মোজাম্বিক, মরিশাস, জিম্বাবুয়ে কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় লুঙ্গি লাম্বা, চিতেঞ্জে, কাপুলানা, পারেওস, জাম্বিয়াস ও কিকোই নামে প্রচলিত রয়েছে। গরম এলাকা এবং আর্দ্র আবহাওয়া বিরাজ করে এমন এলাকায় ট্রাউজার পরিধান কিছুটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মূলত এ ধরণের এলাকাগুলোতেই লুঙ্গির বিস্তার ঘটেছে।


    বিভিন্ন সংস্কৃতিতে লুঙ্গীঃ
    ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে লুঙ্গির বেশ প্রচলন আছে। কেরালায় নারী পুরুষ উভয়েই লুঙ্গি পড়ে থাকেন। এখানে লুঙ্গিকে কিছুটা দরিদ্র পোষাক হিসেব বিবেচনা করা হয়। তামিলনাড়ুতে শুধু পুরুষরাই লুঙ্গি পড়ে থাকেন। মায়ানমারে লুঙ্গিকে লোঙ্গাই বলে ডাকা হয়ে থাকে। এটি মায়ানমারের জাতীয় পোষাক। পুরুষেরা এটি ঘরে বাইরে সর্বত্রই পড়ে থাকেন। মহিলাদের লুঙ্গি এখানে তামাইন হিসেবে সুপরিচিত।


    ইয়েমেনে লুঙ্গিকে ডাকা হয় মা’আউস নামে। ইয়েমেনে সকল বয়সের পুরুষরাই স্বাচ্ছন্দে এই মা’আউস পরিধান করে থাকেন। সোমালিয়াতেও লুঙ্গির মতো পোষাক পুরুষদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। সোমালিয়ায় অফিসের সময় বাদে অন্য সময়ে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ সবাই লুঙ্গি পড়ে থাকেন। সোমালিয়ায় লুঙ্গির সাথে আবার অতিরিক্ত হিসেবে বেল্টও পরিধান করা হয়ে থাকে।
    জাপানেও লুঙ্গির প্রচলন আছে। সেখানে লুঙ্গি একটি উৎসবের পোষাক। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় লুঙ্গিকে সারং বলে অভিহিত করা হয়। এ দুই দেশের মানুষেরা লুঙ্গির ভেতর জামা ইন করে পড়েন। এই লুঙ্গির উপড়ে সোমালিয়ার মানুষের মতো তারা বেল্টও পড়ে থাকেন।
    লুঙ্গি পরতেন মাওলানা ভাসানী। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী, যদি তিনি কোনো কারণে পুরুষ হন, তিনিও লুঙ্গি পরে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হন। ভুটানি ও নেপালিরাও তাদের মতো করে জাতীয় পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রেখেছে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে।


    Sajjadul Islam Rakib 

    Campus Ambassador – Textile Engineers 

    National Institute of Textile Engineering and Research –NITER (10th Batch)

    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Related News

    - Advertisment -

    Most Viewed