◾ঐতিহ্যগতভাবে বাংলা পোশাকের জন্য বিখ্যাত।বহুকাল থেকে যে প্রথাগত পোশাক এদেশের মানুষের পরনে শোভা পাচ্ছে আধুনিক যুগেও তা অনেক সমৃদ্ধ এবং ফ্যাশনেবল।উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙালীর সেলাইবিহীন পরিধানের তথ্য জানা যায় ড. নীহারঞ্জন রায় এর ‘বাঙালীর ইতিহাস’ বই থেকে।তবে বিংশ শতাব্দীতে পোশাকের ইতিহাস অত্যন্ত গতিশীল।
◾সৃষ্টির আদিকাল লগ্নে মানুষ পশুর চামড়া, পাখির পালক,গাছের বাকল ও লতা পাতাকে পরিধেয় হিসেবে ব্যবহার করতো এ কথা সবারই জানা।তবে চিন্তাশীল,সৃজনীশিল্পী এবং বৈচিত্রপ্রিয় মানুষ সচরাচর নিজেকে সুন্দর করে সাজাতেই অধিক আগ্রহী।পৃথিবীর সব জাতিই তার নিজ অঞ্চলের আবহাওয়া,ভাষা,সস্কৃতি এবং ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে মিল রেখে নিজস্ব রীতির পোশাকের পরিচয় বহন করে নিয়েছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ফ্যাশন রীতিও তার গতি আর বাকঁ বদলায় নদীর মতোই।ফলে সব পোশাক সব অঞ্চলের মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়তা পায়না।মধ্যপ্রাচ্যের মতো দাবদাহ অঞ্চলের মানুষ যতটা সম্ভব লম্বা পোশাক বেছে নিয়েছে রোদ থেকে বাচঁতে শীতপ্রধান অঞ্চলের মানুষ ততটাই আটসাট পোশাক বেছে নিয়েছে।কিন্তুু সময়ের পরিক্রমায় পোশাক নির্বাচনে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি,অর্থনীতি ও সৌন্দর্যবোধ।বিভিন্ন সময়ে বাঙালির পোশাকেও এসেছে পরিবর্তন।বিভিন্ন প্রাচীন ভাস্কর্য ও সাহিত্য থেকে আমরা তার কিছুটা আঁচ করতে পারি।
◾প্রাচীন ও মধ্যযুগের যেসব ভাস্কর্য,পোড়ামাটির ফলক,পান্ডুলিপির চিত্র পাওয়া গিয়েছে তা থেকে আমরা ইতিমধ্যেই প্রাচীন বাংলার পোশাক সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এ যুগের মতো পোশাকে ছিলনা কোন রকমারি সাজ,ছিলোনা কোন বাহারি ঢং।ছিল শুধু লজ্জা নিবারন ও শীত গ্রীষ্মসহ বিভিন্ন আবহাওয়ার রুক্ষতা থেকে রক্ষা পাওয়ার ন্যুনতম পোশাক।নারী ও পুরুষ উভয়ই পরতেন একটিমাত্র বস্ত্র শাড়ী অথবা ধুতি।নারী ও পুরুষ উর্ধাঙ্গে অলংকার ছাড়া আর কিছুই পরতেন না।অভিজাত নারীরা কখনো অড়না ব্যবহার করতেন।
◾ইন্দো-মুসলিম যুগে এসে মুসলমানদের প্রভাবে পোশাকে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়।মধ্যযুগের শাসকরা যেসব রুক্ষ অঞ্চলের পোশাক নিয়ে এসেছিলেন চতুর্দশ,পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসে এ অঞ্চলের মানুষ এসব পোশাক পরা শুরু করে।মুকুন্দরামের ‘কবিকঙ্কন চন্দী’ তে এবং শেখ জৈনুদ্দিনের আকাঁ লেডি ইম্পের ছবির মাধ্যমে পাগড়ির প্রচলন জানা যায় যা অভিজাত থেকে শুরু করে চাকর বাকররাও ব্যবহার করতেন।কালিদাসের রচনাতে চিনাংশুক নামক রেশমি পোশাকের ধারণা পাওয়া যায়।এছাড়াও সুলতান ও খানরা পাতলুন,আস্তিনের একটি লম্বা কোট পরত এবং মাথায় পাগড়ি পরত যাকে তাতারিক(তাতারিয়াত) বলা হয়।
◾মুকুন্দরামের লেখা থেকে জানা যায় ষোল শতকের শেষে সচ্ছল বাঙালিরা ইজার বা পাজামা পরতেন।মুসলমানদের অনেকে ধুতির চেয়ে ছোট একখণ্ড কাপড় পরত যাকে এখন বলা হয় লুঙ্গি।সেসময় জুতা পরার রীতি ছিলনা।১৮২০ সালের আকাঁ মহররমের মিছিল ও ঈদের ছবিতে সবাইকে ভালো পোশাকে দেখা গেলেও পায়ে কোন জুতা বা পাদুকা দেখা যায়নি।সমাচার দর্পন পত্রিকায় ১৮৩৫ সালে উল্লেখ করা করা হয় বাবু,জমিদার,সেরেস্তাদার ও উকিল মহাশয়রা জামা,নিমা,কোর্তা পরতেন যা রামমোহন রায় ও দ্বারকনাথ ঠাকুরের ছবিতেও প্রমাণ মেলে।রামমোহন রায়,দ্বারকানাথ ঠাকুর,বঙ্কিমচন্দ্র,স্বামী বিবেকানন্দ সহ সেকালের সব অভিজাত ব্যক্তি তখনও মাথায় পাগড়ি পরতেন।প্যালানাথ বাবুর ‘হুতোম প্যাঁচার’ নকশায় পুজা দেখতে যাওয়া মানুষের যে বর্ননা দিয়েছেন-কোচানো ধুতি,ধোপদুরস্ত কামিজ, শান্তিপুরী ক্রেপ এবং নেটের চাদর।কামিজ,রামজামা বা লম্বা জামা থেকেই সম্ভবত পাঞ্জাবীর উদ্ভব। ইংরেজরা বাংলায় আসার পর তাদের পোশাকের ছাপ পরতে শুরু করে যার মধ্যে অগ্রগন্য ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি পুরোদস্তর ইংরেজদের মত পোশাক পরতেন।বাঙালি অভিজাত সমাজে আরেকটি জনপ্রিয় পোশাক গলাবন্ধ কোট।এটিও খুব জনপ্রিয় ছিল একসময়। হিন্দু,মুসলিম নির্বিশেষে তখনও ধুতি,পাঞ্জাবি, চাদর,লুঙ্গি ইত্যাদি পোশাক পরতেন।মুসলমানরা বাঙলায় আসার আগে সেলাই করা পোশাকের চলন ছিলোনা।মুসলমানরা ধিরে ধিরে এ রীতি চালু করে এবং সেসময় ‘দর্জি’ নামক নতুন প্রথার উদ্ভব হয়।ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে এসে অভিজাত নারীদের ফুলহাতা গলাবন্ধ ব্লাউজ পরার কথা জানা যায়।অভিজাত মুসলমানদের মধ্যে উর্দুভাষী নারীদের অনেকেই সালোয়ার কামিজ পরলেও বাঙালী মুসলিম নারীরা তা পরতেন না।
◾১৯ শতকের শেষদিকে এবং বিশ শতকের প্রথমে বাঙালির পোশাকের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য প্রভাব সুক্ষ্ম ও প্রচ্ছন্নভাবে ধরা পরে।বর্তমানে শাড়ী প্রধান পোশাক হিসেবে থাকলেও তা রেশমি সুতা ও তাতের পাশাপাশি বেনারসি,জামদানি ও নেটের কাপড়ের প্রচলন বেড়েছে।দেশি পোশাকের মধ্যে বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় হলো পাঞ্জাবী,কোর্তা,শেরওয়ানী এবং মেয়েদের সালোয়ার কামিজ,লাহেঙ্গা।শার্ট এবং জ্যাকেটের নতুনত্ব এখন তরুণ প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।শুধু ছেলেরা নয়,বর্তমান মেয়েরাও এখন বিভিন্ন পোশাকের সাথে জ্যাকেট ব্যবহার করছে।এছাড়াও বর্তমানে মেয়েরা টি-শার্ট,টিউনিক,টপের সঙ্গে থ্রি কোয়ার্টার,লেগিংস পরছে।এছাড়াও বিভিন্ন কর্মসূচির জন্য বাঙালিরা পছন্দসই পোশাক পরছে।যেমন -পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে গেলে ট্রাকিং স্যুট,টি-শার্ট,ট্রাউজার পরছে।বিয়ের উৎসবে,ঈদ,পূজা পার্বণে পরছে শাড়ি,কামিজ, লেহেঙ্গা,সারারা ইত্যাদি।বড়দিনে টিউনিক,টপ,ব্লেজার,স্কার্ট ইত্যাদির সাথে প্যান্টের চাহিদা অনেক।অফিসের ক্ষেত্রে ফরমাল পোশাক পরাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যে।অন্যদিকে ছেলেদের পোশাকের ফরমাল থাকার ঝোকটাই বেশি দেখা যাচ্ছে।ফিটিং প্যান্ট ও শার্ট,বিভিন্ন স্টাইলের জিন্স ও তার সাথে ম্যাচের শার্ট ই এখন পছন্দের পোশাক এবং সাথে রাখতে চান বেল্ট,ঘড়ি,স্যু এসবও।বর্তমানে টাই এর ব্যবহারও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
◾বলা হয়ে থাকে,’Dress makes a man perfect’।দিন দিন ফ্যাশন ধারণার ভিত্তি ও চাহিদা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি গতিতে প্রসারিত হচ্ছে।এই বর্ধিষ্ণু ফ্যাশন ক্ষুধা মেটাতে ফ্যাশন হাউজগুলোকে সচেতনতার সাথে নতুন ধারায় তাল মিলিয়ে চলতে হচ্ছে এবং পোশাকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আনতে হচ্ছে।
তথ্যসূত্রঃবাংলা নিউজ 24,প্রথম আলো,Roar media
Written by:
Jeba Yasmin Borsha
Dept. of Apparel Engineering(2nd batch)
Dr. M A Wazed Miah Textile Engineering College.