টেক্সটাইলের ব্যবহার আজকাল কেবল বস্ত্রের সমস্যা সমাধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। দিন দিন বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ বাড়ছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে টেক্সটাইলের ব্যবহার শুরু আজকে থেকে নয়। টেক্সটাইল প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সমন্বয়ের ফলে মেডিকেল টেক্সটাইল নামে একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে যা মেডিকেল টেক্সটাইল বা হেলথকেয়ার টেক্সটাইল নামে পরিচিত।
মেডিকেল টেক্সটাইলের ইতিহাস বেশ পুরনো, খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ অব্দে সুমেরিয়ান সভ্যতা তাদের চিকিৎসা শাস্ত্রের বিভিন্ন ব্যান্ডেজ , প্লাস্টার তৈরিতে টেক্সটাইলের ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়। মেডিকেল টেক্সটাইল, ট্যাকনিকাল টেক্সটাইল এর অন্তর্ভুক্ত এবং এটি ট্যাকনিকাল টেক্সটাইলের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেএ।
মেডিকেল টেক্সটাইল শব্দটি মুলত এমন সব টেক্সটাইলকে বোঝায় যে সব টেক্সটাইল প্রাথমিক চিকিৎসা, ক্লিনিকাল চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপচার এর কাজে ব্যবহৃত হয়।এ ক্ষেএটি বিকাশের জন্য আনা হয়েছে নানা ধরনের নতুন ফাইবার এবং উদ্ভাবন করা হয়েছে নতুন ফাইবার ও ফ্যাব্রিক ম্যানুফেকচারিং পদ্বতি। টেক্সটাইলে নতুন পদ্বতি উদ্ভাবনের লক্ষই থাকে যে কিভাবে ব্যাবহারকারীর আরাম বৃদ্ধি করা যায়। আর মেডিকেল টেক্সটাইল কে এ ক্ষেএে অগ্রগামী হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে কারন রোগীদের বেদনাদায়ক দিন গুলোকে আরামদায়ক করার ক্ষেএে মেডিকেল টেক্সটাইল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
⚫মেডিকেল টেক্সটাইলে ব্যাবহৃত বিভিন্ন ফাইবার ও এদের ব্যাবহার :
১) তুলা: অস্ত্রোপচারের পোশাক গাউন, বিছানা, শিট, বালিশের কভার, ইউনিফর্ম, সার্জিকাল হোসিয়ারি
২) ভিসোকোজ (Viscose) : ক্যাপস, মাস্কস, ওয়াইপস
৩) পলিয়েস্টার (Polyester): গাউন, মাস্কস, সার্জিকাল কভার ড্রপস, কম্বল, কভারস্টক
৪) পলিমাইড(Polymide) : সার্জিকাল হোসিয়ারি
৫)পলিপ্রোপিলিন(Polypropylene):প্রতিরক্ষামূলক পোশাক
৬) পলিথিন (Polyethylene): সার্জিকাল কভার, ড্রপস
৭) গ্লাস: ক্যাপস মাস্ক
৮)এলাস্টোমেরিক (Elastomeric): সার্জিকাল হোসিয়ারি
⚫আধুনিক যুগে টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালকে মেডিকেল টেক্সটাইলে প্রয়োগ করার জন্য টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালের যেসব গুনাবলি থাকার দরকার –
১) এটি অ-বিষাক্ত হতে হবে অর্থাৎ এতে কোন বিষাক্ত উপাদান থাকবেনা এবং এটি রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় হওয়া উচিত।
২) এর স্থায়ীকতা , নমনীয়তা ও কোন আঘাত অথবা বল সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে ।
৩) আদ্রতা শোষণ ক্ষমতা থাকতে হবে। ক্ষার, এসিড, মাইক্রো-অর্গানিজম জাতীয় পদার্থ প্রতিরোধের ক্ষমতা থাকতে হবে।
৪)দূষণ বা অশুচি থেকে মুক্ত হবে এবং বায়ু চলাচল যোগ্য হবে।
মেডিকেল টেক্সটাইল সামগ্রীর সমূহ:
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা পণ্যের জন্য টেক্সটাইল সামগ্রী ব্যবহার মূলত নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলিতে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়-
১) ক্ষত ড্রেসিং, প্লাস্টার, ব্যান্ডেজ, গেজ ইত্যাদি দ্রব্যাদি তৈরিতে
2) কৃত্রিম লিগামেন্ট তৈরিতে , কৃত্রিম কিডনি, কৃত্রিম যকৃত, কৃত্রিম ফুসফুস ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়
৩) অপারেটিং গাউন, অপারেটিং ড্রেস, স্টারলাইজেশন প্যাকগুলি, ড্রেসিং, সিউচার এবং অস্থিরোপকারী প্যাড
৪) ননওভেন গাউন , মেডিক্যাল গ্লাভস, গাউন , মাস্ক, শিশুর ডায়াপার, স্যানিটারি ন্যাপকিন, সারজিকাল ক্যাপ, প্লাস্টার
⚫মেডিকেল টেক্সটাইলে ন্যানো টেকনোলোজি এর ব্যবহার:
ন্যানো টেকনোলোজি আধুনিক মেডি টেক এ নতুন মাত্রা যোগ করছে। আধুনিক মেডিটেক এ জীবানুনাশক ফাইবার তৈরিতে ন্যানো টেকনোলোজি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এ ক্ষেত্রে মেডিটেকে ব্যবহৃত ফাইবারকে ন্যানো সিনথেটিক ফাইবারের সাথে treat করে জীবানুনাশক ফাইবার তৈরি করা হয়। ন্যানো টেকনোলোজি এর বদৌলতে প্রাপ্ত জীবানু নাশক এজেন্ট বিভিন্ন Toxic এজেন্ট মানব শরীরকে রক্ষা করে।
⚫মেডিকেল টেক্সটাইল এর বৈশ্বিক বাজার:
অন্যান্য সকল টেক্সটাইল পন্যের বাজারের মধ্যে মেডিকেল টেক্সটাইল বাজারের আকার ৫ম। সম্প্রতি “Tata Economy Consultancy Services”দ্বারা পরিচালিত মেডিকেল টেক্সটাইলের সার্ভে অনুসারে ২০০০ সালে বিশ্ব মেডিক্যাল টেক্সটাইল বাজারের মূল্য ছিল ১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং যা বাষিক হারে ৪.৬% বাড়ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে যা ২৩.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছে। সূত্রমতে ২০০৩-০৪ সালে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে মেডিকেল টেক্সটাইলের বাজারের পরিমান ছিল ১.৩ মিলিয়ন। তারা এ খাতে দিন কে দিন উন্নতি করেই যাচ্ছে যা আমাদের কাছে এ খাতে উন্নতি করার উদাহরণস্বরূপ হতে পারে।
⚫মেডিকেল টেক্সটাইল খাতে বাংলাদেশের সুযোগঃ
বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবা সেবার জন্য বিশাল পরিমান অর্থের প্রয়োজন। বেসরক্যরী খাতের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বাজারের ৭০% এর চেয়ে বেশি যা তুলনামূলকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলির পাশাপাশি উন্নত দেশগুলির সমান। করোনা ভাইরাসের(COVID-19) প্রভাব সারা বিশ্ব ঠিকভাবে মোকাবেলা করতে হিমশিম খেয়ে গিয়েছে, কারন তাদের যথেষ্ট পরিমান স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর মজুদ ছিল না ও সঠিক জোগান দিতে পারে নি। এখানে বাংলাদেশী নির্মাতারা এটি নিয়ে ভাবতে পারেন এবং এটিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি সুযোগ হিসাবে নিতে পারেন। নিয়মিত ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলি তাদের অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছে, একই সাথে সারা বিশ্বের পিপিই চাহিদা বাড়ছে আকাশের উচ্চ। এমতাবস্থায় কারখানায় মালিকেরা তাদের ব্যবসা দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে মেডিকেল বিভিন্ন সামগ্রী প্রস্তুতের পদক্ষেপ নিতে পারে।
সম্প্রতি মহামারি করোনা কালে সুখবর দিয়েছে দেশের অন্যতম টেক্সটাইল কোম্পানি জাবের এন্ড জোবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেড।তাদের উদ্ভাবিত কাপড়ে নির্মূল হবে করোনা সহ সকল ধরনের ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া।যা উক্ত কাপড়ে ১২০ সেকেন্ড এর বেশি বেচে থাকতে পারবে না এবং ২০-৩০ বার পর্যন্ত পরা যাবে যা ইউএসএ এবং ইউরোপ স্বীকৃত এবং ব্যাবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে।
টেক্সটাইল পন্য গুলো দিন দিন উচ্চ প্রযুক্তির ব্যাবহারে আরও বেশি আকর্ষণীয় পরিবর্তন নিয়ে বাজারে আসছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানী , মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ফিজিওলজিস্ট এবং টেক্সটাইল বিজ্ঞানীদের সাথে সর্বাধিক জ্ঞান, দক্ষতা এবং পরিশ্রমের ফসল হিসেবে মেডিকেল টেক্সটাইলের দিগন্ত দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে এবং তাদের পারদর্শিতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপিত হচ্ছে। প্রতিটি দেশের মেডিকেল টেক্সটাইলগুলির নিজস্ব মান রয়েছে এবং চিকিৎসা পদ্ধতির বিকাশ অব্যাহত থাকায় মেডিকেল টেক্সটাইল উপকরণগুলির গুনগত মান ও চাহিদা দিন দিন অবশ্যই বাড়তে থাকবে।সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের ভয়াল আঘাতে বিশ্ববাসী মেডিকেল টেক্সটাইলের গুরুত্ব উপলব্ধিতা বেড়েছে।
Information Source :
Textile Today ,Textile Lab ,Technical Textile, Prothom Alo.
Writers Information
১)নাজমুল ইসলাম নিরব
২)আশিক মাহমুদ
৩)সাঈদ আল সাদাফ
ডিপার্টমেন্ট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং
জাতীয় বস্ত্র প্রকৌশল ও গবেষণা ইন্সটিটিউট – নিটার