ভূমিকাঃ বিশেষ কতগুলো নিয়ম অনুসরণ করে সুন্দর সুশৃঙ্খলভাবে কোন কিছু তৈরি করাকে শিল্পকলা বলা হয়। মানুষের অনুভূতির প্রকাশই শিল্প।গৃহসজ্জা,খাদ্য প্রস্তুত,পরিবেশন,পোশাক পরিচ্ছদ, পরিধান, কেশবিন্যাস প্রত্যেকটি ক্ষেত্রই শিল্পকলার ছোঁয়ায় সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে ওঠে। তবে শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিল্পকলার উপাদান ও নীতিসমূহের যথাযথ ব্যবহার ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
পোশাকে শিল্পকলার উপাদানঃ শিল্পকলার বিভিন্ন উপাদান প্রয়োগ করে পোশাককে সুন্দর, আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলা যায়। শিল্পকলার উপাদানগুলো নিম্নরুপঃ
১। রং(Colour)
২। রেখা(Line)
৩। আকার(Shape)
৪। জমিন(Texture)
৫। বিন্দু (Dot).
১। রং (Colour): পোশাকের ডিজাইনে রং এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রং এর পরিবর্তনে ডিজাইনটি আমূল পরিবর্তিত হতে পারে। পোশাকে ডিজাইনের মূল কাঠামোর কোন পরিবর্তন না করে কেবল রং পরিবর্তন করেও পোশাকে অসংখ্য বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা যায়। আবার রং এর সঠিক ব্যবহার না হলে পোশাকটির সৌন্দর্য ব্যহত হয়। রং এর বিভিন্ন প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন- পোশাকে লাল রঙের ব্যবহারের ফলে মানসিক প্রশান্তির অনুভূতি লাভ করা যায়। মনকে আনন্দ ও উৎফুল্লে ভরে তোলার ক্ষেত্রে হলুদ রং এর পোশাকের ভূমিকা রয়েছে। পোশাকে সাদা রং শুভ্রতা আনয়ন করে। পোশাক সুন্দর, আকর্ষণীয় ও মনোরম করে তোলার ক্ষেত্রে
রং এর ভূমিকা সর্বাধিক।
রং ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিচয়ও পাওয়া যায়। ব্যক্তিত্ব বিকাশে রঙের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উজ্জ্বল রং ব্যবহারের ফলে শ্যামলা মেয়েকে ততটা শ্যামলা মনে হয়না, অপর দিকে ফর্সা মেয়ের জন্য হালকা রং উপযোগী। এছাড়াও ব্যক্তির বয়স,শারীরিক গঠন,আবহাওয়া, উৎসব ও উপলক্ষ্য প্রভৃতি ভেদে রং এর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
২। রেখা (Line): পোশাকের আকর্ষণীয় ডিজাইন সৃষ্টিতে রেখা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।রেখার বিভিন্ন ব্যবহারের ফলে পোশাকে আসে বৈচিত্র্য। লম্বা, আড়াআড়ি, খাড়া, গোল, তির্যক প্রভৃতি রেখার ব্যবহার একদিকে যেমন পোশাককে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলে অন্যদিকে বিভিন্ন ভাবের সৃষ্টি করে। যেমন-
লম্বা রেখা বা খাড়া রেখা (Vertical Line):
লম্ব রেখা দৈর্ঘ্য বাড়ার ফলে ব্যক্তিকে লম্বা দেখা যায়। সে কারণে যারা মোটা ও বেঁটে তাদের লম্ব রেখার পোশাক পরিধানের ফলে আপাতদৃষ্টিতে ততটা মোটা ও বেঁটে মনে হয়না। লম্ব রেখা সাহস ও সততা প্রকাশ করে। আড়াআড়ি বা সমান্তরাল রেখা(Horizontal Line): আড়াআড়ি বা সমান্তরাল রেখা দৃষ্টিকে কাছে নিয়ে আসে ও
দৈর্ঘ্য কমায়। সে কারণে ছোট ও প্রশস্ত মনে হয়। লম্বা রোগাপাতলাদের আড়াআাড়ি রেখার পোশাক পরিধান করলে ততটা রোগা পাতলা ও লম্বা মনে হবেনা। আড়াআড়ি রেখা বিশ্রাম ও আরামের অনুভূতি আনে।
বক্র রেখা (Curve Line): বক্ররেখা দৈর্ঘ্য কমায় সেই সাথে সৌন্দর্য ও লাবণ্য সৃষ্টি করে। ব্যক্তির মধ্যে চঞ্চল ভাবের সৃষ্টি করে।
তির্যক বা কোণাকুণি রেখা (Diagonal Line): তির্যক বা কোণাকুণি রেখা দৈর্ঘ্য বাড়াতেও পারে কিংবা কমাতেও পারে। দ্বৈত ভূমিকা পালনে তির্যক রেখা সহায়তা করে। ফলে কখনো কখনো পোশাক লম্বা ও কখনো কখনো খাটো ও প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে তির্যক রেখা ব্যবহৃত হয়। তির্যক রেখা সংযমের পরিচয় দেয়।
জিগজ্যাগ রেখা (Zigzag Line): জিগজ্যাগ রেখা পোশাককে আরামদায়ক, গতিশীল ও বৈচিত্র্যময় করে তোলে। এ ধরনের রেখার অধিক ব্যবহার আরামদায়ক হয়না।
৩। আকার (Size): প্রত্যেকটি পোশাকের এক একটি আকার থাকে। পোশাকের আকার পোশাককে সৌন্দর্যময় ও কার্যকরী করে তোলে। যেমন- সালোয়ার ও কামিজের আকার। পোশাকের আকার আকৃতি ব্যবহার করে ব্যক্তিকে আপাত দৃষ্টিতে ছোট বা বড় করা যায়। পোশাকে বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে আকৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন- কামিজ বা ব্লাউজের গলার আকার (ভি), (ইউ), (গোল), (চার কোণা) আকৃতি দিয়ে একদিকে সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য আনয়ন করা যায়, অন্যদিকে দৈহিক দোষত্রুটিও ঢাকা যায়।
৪। জমিন (Texture): যে কোন বস্তুর উপরিভাগের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে জমিন বলে। পোশাকের ক্ষেত্রেও জমিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাপড়ের জমিন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।যেমন- মসৃণ, অমসৃণ,মোটা,মিহি বা পাতলা জমিন। মসৃণ জমিনের পোশাক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে। মসৃণ জমিনের পোশাক ব্যক্তির আকৃতিকে বড় করে। ব্যক্তির শারীরিক গঠন কে স্পষ্ট করে তুলতে পারে। মসৃণ জমিনে বিভিন্ন ধরনের নকশা সৃষ্টি করা যায়। অপরদিকে খসখসে জমিনের পোশাক ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ম্লান করে দেয়। জমিন বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। খসখসে জমিনের পোশাক ব্যক্তির আকৃতিকে ছোট করে। অমসৃণ বা খসখসে জমিন দিয়েও পোশাক আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময় করে তোলা যায়। মসৃণ জমিনে যে কোনো রং চকচকে দেখায় এবং অমসৃণ জমিনে রং হালকা হয়ে যায়। শীতকালের জন্য মোটা জমিন ও গ্রীষ্মকালের জন্য পাতলা মিহি জমিনের পোশাক উপযুক্ত।
৫। বিন্দু (Dot): বিন্দু শিল্পকলার একটি উপাদান। গোলাকৃতি ক্ষুদ্র ফোটা বা দাগকে বিন্দু বলে। শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিন্দুকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়। বিন্দুর বহুবিধ ব্যবহারের ফলে পোশাকে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। পোশাকে শিল্পকলার নীতিঃ শিল্পকলার নীতি অনুসরণ ছাড়া শিল্প সৃষ্টি সম্ভব নয়। শিল্পকলার নীতি যথাযথ প্রয়োগের ফলেই শিল্প আকর্ষণীয়,বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর হয়ে ওঠে। সুন্দর, আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যময় পোশাকের ক্ষেত্রে শিল্পকলার নীতিসমূহ যথাযথ অনুসরণ করতে হবে। শিল্পকলার নীতিসমূহের মধ্যে রয়েছে ভারসাম্য, অনুপাত, ছন্দ, মিল,প্রাধান্য।
★ সমতা বা ভারসাম্য (Balance): কোন বস্তুর যথাযথ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে হলে বস্তুর মধ্যে সমতা বা ভারসাম্য থাকতে হবে। ভারসাম্য বা সমতার অভাব ঘটলে সৌন্দর্য বাধাগ্রস্হ হয়। পোশাকের সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও সমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমতা বা ভারসাম্য দুই প্রকার,যথা-
১। প্রত্যক্ষ ভারসাম্য
২। অপ্রত্যক্ষ ভারসাম্য
১) প্রত্যক্ষ ভারসাম্যঃ কোন পোশাকের উভয়পাশে বা দুই দিকে যদি একই আকারের বা একই ডিজাইনের হয় তখন আমরা তাকে প্রত্যক্ষ ভারসাম্য বা প্রত্যক্ষ সমতা বলে থাকি। যেমন- কোন পোশাকের উভয় কাঁধ বরাবর নিচের দিকে কোন নকশা বা ডিজাইন দিয়ে প্রত্যক্ষ ভারসাম্য সৃষ্টি করা যায়। আবার অনেক সময়
দুইপাশে ওড়না পড়ে প্রত্যক্ষ ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়।
২) অপ্রত্যক্ষ ভারসাম্যঃ পোশাকে দুইপাশে একই ধরনের না হয়ে দুই পাশ দুই রকম হলে অপ্রত্যক্ষ ভারসাম্য হয়। যেমন- কোন পোশাকের কাঁধের নিচ বরাবর একপাশে ডিজাইন দিয়ে অপ্রত্যক্ষ ভারসাম্য সৃষ্টি করা যায়।
★ অনুপাত বা সংগতি(Proportion): কোন বস্তুর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংগতি থাকা আবশ্যক। যেমন- পোশাকের ক্ষেত্রে পোশাকের রং,নকশা, ডিজাইন, আকার,গঠন প্রভৃতির মধ্যে অনুপাত বা সংগতি থাকতে হবে। পোশাকের মধ্যে এসবের পারস্পরিক অনুপাত সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে পোশাকের সৌন্দর্য যেমন ফুটে উঠবে না পোশাকটি ব্যবহারেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে না। কাজেই পোশাকের সৌন্দর্য, আকর্ষণীয় ও ব্যবহারপযোগী করতে হলে অনুপাত বা সংগতির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
★ ছন্দ (Rhythm): শিল্পের ছন্দ রক্ষা করা শিল্পকর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ছন্দের মাধ্যমে চোখের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। ছন্দ পতনের ফলে চোখের দৃষ্টি বাধাগ্রস্হ হয়। ছন্দ এমন একটি শিল্পনীতি যা মানুষের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে। পোশাকের রং, নকশা, আকার,আকৃতির মাধ্যমে ছন্দ প্রবাহিত হয়। পোশাকে বিভিন্ন রেখা, বিন্দু বা নকশার মাধ্যমে ছন্দ সৃষ্টি করা যায়।
★ মিল (Harmony): শিল্প সৃষ্টিতে বিভিন্ন শিল্প বস্তু ব্যবহৃত হয়। এ সমস্ত শিল্প বস্তু সমাবেশের মিত্রতার নামই সমন্বয় বা মিল। পোশাকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সামগ্রীর মধ্যে মিল থাকতে হবে। যেমন- পোশাকের নকশার সাথে রং,জমিন,আকার,আকৃতি প্রভৃতির মিল থাকতে হবে। উদাহরণস্বরুপ, সালোয়ার-কামিজ-ওড়নার মধ্যে মিল
থাকতে হবে। ত না হলে পোশাকের সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা কখনোই সম্ভব হবে না।
★ প্রাধান্য (Emphasis): প্রাধান্যের মাধ্যমে পোশাক সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। পোশাকের আকর্ষণ সৃষ্টি করার জন্য যে নকশা বা ডিজাইন করা হয় তাই প্রাধান্য। বিভিন্ন রং, নকশা বা ডিজাইন প্রয়োগ করে পোশাকের প্রাধান্য সৃষ্টি করে সাধারণ পোশাককেও অসাধারণ করে তোলা সম্ভব। পোশাকের মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। আর ব্যক্তিত্ব সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে প্রয়োজন পোশাকে যথাযথ ভাবে শিল্পউপাদান ও শিল্পনীতির প্রয়োগ।
তথ্যঃ www.ebookbou.edu.bd.
✒️ লেখিকা পরিচিতি:
সাদিয়া তামান্না বিনতে তাইফুর
৪র্থ বর্ষ, ব্যাচ ২১
বস্ত্রপরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প বিভাগ
বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ।