আধুনিককালে প্রযুক্তি বিকাশের সাথে সাথে টেক্সটাইল ফাইবারের ও টেক্সটাইল সামগ্রীর প্রভূত উন্নতি হচ্ছে এবং ব্যবহারকারীদের কাছে টেক্সটাইল সামগ্রী সহজলভ্য হচ্ছে। সাধারনত সুতা তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে যে তন্তু বা আঁশ ব্যবহৃত হয়, সেগুলোকে টেক্সটাইল ফাইবার বলে।
গত পর্বে আমরা কয়েকটি ম্যান-মেড ফাইবার বা কৃত্রিম ফাইবারের আবিষ্কার, উৎস এবং বর্ননা সম্পর্কিত তথ্যাবলী সম্পর্কে জেনেছিলাম। আজকে আমরা আরো কয়েকটি ফাইবার এর পরিচিতি জানবো এবং বিস্তারিত আলোচনা করবো।
◾পলিয়েস্টারঃ
১৯৫৩ সালে এর প্রোডাকশন শুরু হয় এবং সবচেয়ে বেশি ব্যাবহৃত কৃত্রিম ফাইবার।Polyester কথাটার মানে হচ্ছে অনেকগুলো এস্টার (Ester) মিলে তৈরি একটা পলিমার। পলিএস্টারে এস্টারগুলো পরস্পরের সাথে Ester Linkage দিয়ে যুক্ত থাকে।পলিএস্টার গুলো অন্যান্য উপাদানের সাথে যুক্ত হয়ে ভিন্ন ধরনের সুতা তৈরি করে।
◾নাইলনঃ
E.I Du Pont De Nemours & Company কর্তৃক নাইলনের প্রথম বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। ব্যাবহারের দিক দিয়ে বর্তমানে পলিইয়েস্টারের পরই নাইলন।নাইলন রাসায়নিকভাবে পলিঅ্যামাইড প্রকরণের ফাইবার। অ্যামাইডের রাসায়নিক সংকেত (-CO-NH-) । এর পলিমারাইজেশন করে পলি অ্যামাইড গঠিত হয়, যাকে নাইলন বলে। পলি অ্যামাইডের লম্বা চেইন একটি সিনথেটিক পলিমার যার মধ্যে কমপক্ষে ৮৫% অ্যামাইড লিংকেজ সরাসরি দুটি অ্যারোমেটিক রিং দ্বারা যুক্ত থাকে ।
নাইলন বেশ শক্তিশালী,স্থিতিস্থাপক ও উজ্জল। এতে যেকোন রঙ প্রয়োগ করা যায়,খুব বেশি পানি ধারণ করে না,ওজনে হালকা কিন্তু শরীরের তাপ ধারণ করতে সক্ষম ।
◾কার্বনঃ
কার্বন অনুর ৫ থেকে ১০ মাইক্রোমিটার ব্যাসের সুক্ষ্ম তন্তু হচ্ছে কার্বন ফাইবার।কার্বন ফাইবারের একটি সুতা তৈরী করতে কয়েক হাজার তন্তু পাকিয়ে সুতা তৈরী করা হয়।এরা বেশ শক্তিশালী, উচ্চতাপ ও উচ্চচাপ সহ্যক্ষমতা প্রদর্শন করে।
স্পোর্টস শিল্পে এদের ব্যবহার করা হয়।
◾গ্লাস ফাইবারঃ
গ্লাস ফাইবার বা কাচ তন্তু হল কাচের অনেকগুলো সূক্ষ্ম এবং শক্তিশালী তন্তুর সমন্বয়। ১৮৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড কলম্বিয়ান এক্সোজিশনে এডওয়ার্ড ড্রুমন্ড লিব্বি সর্বপ্রথম রেশম সুতার সাথে কাচ তন্তু মিশিয়ে একটি পোশাক বানিয়ে প্রদর্শন করেন। এটিই ছিল কাচ তন্তুর তৈরী প্রথম পরিধেয় পোশাক। এছাড়া প্রবল বাতাসে আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপন্ন কাচ থেকেও প্রাকৃতিকভাবে কাচ তন্তু উৎপন্ন হয়।
বর্তমানে তাপ নিরোধক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত ফাইবার গ্লাস উৎভাবন করেন রাসেল জেমস স্লেটার।
◾ম্যান-মেড ফাইবার তৈরীর ফ্লোচার্ট :
কৃত্রিম ফাইবারের সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুতি বেশকিছু ধাপে সংঘটিত হয়ে থাকে। এদের কে ফ্লোচার্ট আকারে নিম্নলিখিতভাবে দেখানো যায়:
কাঁচামাল সংগ্রহ
↓
বিশুদ্ধকরণ
↓
পলিমারাইজেশন
↓
স্পিনিং
↓
ড্রইং এন্ড স্ট্রেচিং
↓
টেক্সারাইজেশন
↓
ইন্টারলেসিং
↓
হিটসেটিং
↓
ফিলামেন্ট
◾ফ্লোচার্টের সংক্ষিপ্ত বিবরন:
★কাঁচামাল সংগ্রহ: সর্বপ্রথম ফিলামেন্ট তৈরীর জন্য কাঁচামাল সংগ্রহ করতে হবে।
★বিশুদ্ধকরণ : কাঁচামাল থেকে পলিমারাইজেশন পদ্ধতিতে পলিমার তৈরী করা হয় এই ধাপে। রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে বা রাসায়নিক সংমিশ্রণ এর মাধ্যমে পলিমারাইজেশন করতে হয়।উল্লেখ্য, এখানে একটা রিপিটিং ইউনিট থাকে যেটিকে বার বার পলিমারাইজেশন করতে হয়।
★স্পিনিং: প্রাকৃতিক ফাইবার এর ক্ষেত্রে সুতা পাকানোর প্রক্রিয়াকে স্পিনিং বলে। তবে কৃত্রিম ফাইবার এর ক্ষেত্রে ক্যামিকেল থেকে ফিলামেন্ট তৈরীর প্রক্রিয়াকে স্পিনিং বলা হয়। এক্ষেত্রে স্পিনিং মূলত তিনটি প্রক্রিয়ার করা যায়। ১. ওয়েট স্পিনিং ২. ড্রাই স্পিনিং ৩. মেল্ট স্পিনিং
পূর্ববর্তী পর্যায়ে উৎপন্ন কাঁচামালগুলো দ্রবীভূত আকারে থাকে। সেজন্য স্পিনিং করানোর জন্য বিভিন্ন আকৃতির স্পিনারেট ব্যবহার করা হয়। স্পিনারেট হলো যার সাহায্যে স্পিনিং সংঘটিত হয়।
★ড্রইং এন্ড স্ট্রেচিং: ড্রইং হচ্ছে “টেনে ধরা” অর্থাৎ স্পিনিং এর পর যখন সমস্ত ফাইবার একত্রিত হয় তখন ড্রইং রোলারের সাহায্যে সেগুলোকে টেনে ধরা হয়। আর স্ট্রেচিং হচ্ছে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ফাইবারের স্থায়িত্ব বজায় রাখা। কাজটি যেখানে সম্পন্ন হয় সেখানে একটি “ড্রায়ার” থাকে। ড্রইং এবং স্ট্রেচিং এর পর ড্রায়ারে ফাইবার কে শুকানো হয়। এভাবেই এই পর্যায়টি সম্পন্ন হয়।
★টেক্সারাইজেশন:
সাধারণত কৃত্রিম ফাইবারের স্পিনিং এবিলিটি থাকেনা যা প্রাকৃতিক ফাইবারের থাকে। টেক্সারাইজেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কৃত্রিম ফাইবারকে প্রাকৃতিক ফাইবারের গুণাবলীতে রুপান্তর করা হয়।
★ইন্টারলেসিং:
একটি সিনথেটিক ফাইবারের মাধ্যমে শক্তিশালী ফাইবার তৈরী করা সম্ভব হয়না। তাই একাধিক ফাইবার একত্রিত করে স্পিনিং এর সাহায্যে অধিক শক্তিশালী ফাইবারের পরিণত করার প্রক্রিয়াকে ইন্টারলেসিং বলা হয়। এই পর্যায়ে ফাইবারটি অধিক শক্তিশালী ফাইবারের গুণাগুণ লাভ করে।
★হিটসেটিং:
এই পর্যায়ে প্রাকৃতিক তাপমাত্রা, বডি টেম্পারেচার এবং বাহ্যিক তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে তাপীয় অবস্থার সৃষ্টি করা হয়। যার লক্ষ্য হচ্ছে ফাইবার থেকে তৈরীকৃত পোশাক যেন বিভিন্নরকম বাহ্যিক তাপমাত্রার প্রভাবে তার নিজের স্থায়িত্ব হারিয়ে না ফেলে তা নিশ্চিত করা।
★ফিলামেন্ট:
সকল ধাপ সম্পন্ন হবার হর একটি আদর্শ ফিলামেন্ট তৈরী হয়ে যায়।
এটিই হচ্ছে আদর্শ গুণাগুণসম্পন্ন কৃত্রিম ফাইবার।
◾সবশেষে, ম্যান-মেড ফাইবার বা কৃত্রিম ফাইবারের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করা যাক :
১৮৫৭ সালে সর্বপ্রথম কৃত্রিম ফাইবার আবিষ্কৃত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত এরকম ১৮-২০ টি কৃত্রিম ফাইবার আবিষ্কৃত হয়েছে বা সেগুলো নিয়ে গবেষণা চলছে। কৃত্রিম ফাইবারের নানা রকম উপকারিতার দিকে লক্ষ রেখে বর্তমানে গবেষকগণ কৃত্রিম ফাইবার এর উন্নতিকরনের লক্ষে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিভাবে গুনগত মান এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে নতুন নতুন কৃত্রিম ফাইবার তৈরী করা সম্ভব হবে সেটার লক্ষে সকলকেই কাজ করতে হবে এবং প্রচুর পরিমানে রিসার্স করতে হবে। এভাবেই,ধীরে ধীরে আরও উন্নতমানের কৃত্রিম ফাইবার আবিষ্কৃত হবে যা টেক্সটাইল শিল্পের অগ্রগতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
তথ্যসূত্র :উইকিপিডিয়া, গুগল।
Writer Information:
Md Rashid
Research Assistant
Textile Engineers Society
Dr. M A Wazed Miah Textile Engineering College