আধুনিক জীবনের জটিলতাজনিত টানা পোড়নের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য মানুষ সৃজনশীল গৃহ নৈপূণ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ‘টাই এন্ড ডাই’ প্রণালীর কারুশিল্প বিশেষভাবে সরকারি আবেদন সৃষ্টি করেছে। এই প্রণালীতে রঞ্জিত বস্ত্র খুব চিত্রাকর্ষক, মনোহর ও অপূর্ব হয়।
টাই এন্ড ডাইঃ
টাই শব্দের অর্থ বাঁধা আর ডাই অর্থ রঙ। অর্থাৎ বন্ধন এবং রঞ্জন এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘টাই এন্ড ডাই'(Tie & Dye)।
বাঁধন পদ্ধতিতে ফেব্রিকে রঙ করাকে ‘টাই এন্ড ডাই’ বলে। ফেব্রিক বাঁধার ফলে রঙ লাগা ও না লাগা অংশ মিলে নকশার সৃষ্টি হয়, এটাই হলো টাই-ডাই।
টাই-ডাই এর ইতিহাসঃ
টাই-ডাই কখন কোথায় কিভাবে আরম্ভ হয়েছে সেটি সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন গবেষকরা গবেষণার মাধ্যমে অনুমান করে নিয়েছেন এর প্রথম উদ্ভাবন চীন এবং জাপানে। যুগ যুগ ধরে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এ প্রক্রিয়ায় বস্ত্র রঙ করা চলে এসেছে। অন্যদিকে ষাট ও সত্তরের দশকে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে টাই-ডাই করা কাপড়। এখন অবশ্য টাই-ডাই প্যাটার্ন আর সে রকম নেই। সফিস্টিকেটেড কালার ও মোটিফ এখন বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে টাই-ডাইয়ের ক্ষেত্রে। ম্যাটেরিয়ালেও এসেছে পরিবর্তন। এক সময় মূলত সুতি কাপড় ব্যবহৃত হলেও এখন বিভিন্ন ফ্যাশন ফেব্রিক ব্যবহার করা হচ্ছে টাই-ডাই করার জন্য।
ফ্যাশনে টাই এন্ড ডাই পোশাকঃ
ফ্যাশনে টাই-ডাই পুরোনো হলেও নিত্যনতুন রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে বারবার। সুতি, খাদি, সিল্ক, হাফ-সিল্ক, লিনেন, তসর, মসলিন, এন্ডি, কটনসহ নানা ধরনের কাপড়েই করা হয় টাই-ডাই। এমনকি নিজের হাতেও পছন্দের নকশা অনুযায়ী করা যায় টাই-ডাইয়ের কাজ। আজকাল ফ্যাশন ডিজাইনাররা টাই-ডাইকে শুধু রঙের পদ্ধতি হিসেবে নয়, বরং তার চেয়ে বেশি আর্ট বা চিত্রকর্ম হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন বস্ত্রে নকশা করা হয়, যেমন- গলাবদ্ধ, রুমাল, ওড়না, চাদর, পিলো কভার, কুশন, পর্দা, বিছানার চাদর, টেবিলের কাপড় ইত্যাদি। ইদানিং শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পান্জাবীও প্রস্তুত করা হচ্ছে। টাই-ডাই করা শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ওড়না, স্কার্ট, ফতুয়া, স্কার্ফ, শার্ট, পান্জাবী আরামদায়ক ও ফ্যাশনেবল। বিশেষ করে গরমে সুতির প্রাকৃতিক রঙের পোশাক বেশ আরামদায়ক। এছাড়া জিনস, লেগিংস বা জেগিংসের সঙ্গে অনায়াসেই পড়া যায় টাই-ডাই করা ফতুয়া বা টপ। সঙ্গে থাকতে পারে টাই-ডাইয়ের স্কার্ফ বা ওড়না। একরঙা টপসের সঙ্গে ডাই করা স্কার্টও মানানসই। আবার চাইলে নকশিকাঁথাতেও ফুটিয়ে তোলা যায় টাই-ডাইয়ের ছাপ। এছাড়াও টাই-ডাইয়ের কাপড়ের উপর বিভিন্ন স্টিচ করে ওয়ালম্যাট তৈরি করা যেতে পারে। এতে করে দেয়ালেও আসবে টাই-ডাইয়ের ছোঁয়া।
যেভাবে করা হয় টাইডাইয়ের কাজঃ-
(০১) কাপড় নির্বাচনঃ
সুতি, লিনেন, সিল্ক, রেয়ন এবং নানা প্রকার মিশ্র সুতার কাপড়ে এ নকশা তোলা যায়।
(০২) কাপড় মাড় মুক্তকরণঃ
অবাঞ্ছিত দাগ, তেল ও মাড়মুক্ত করার জন্য প্রথমে কাপড়টি সাবান ও সোডার সাহায্যে ধৌত করতে হবে। এরপর একটি গামলায় প্রতি সাড়ে তিন লিটার গরম পানিতে এক কাপের তিন-চতুর্থাংশ ডাই ফিচার (যেমন- সোডিয়াম কার্বনেট) মিশিয়ে কাপড় ৫-১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর শুকিয়ে ইস্ত্র করে নিতে হবে।
(০৩) বন্ধন প্রক্রিয়াঃ
নির্ধারিত নকশা অনুযায়ী ভাঁজ করে, সেলাই করে বা পেঁচিয়ে মোটা সুতা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে কয়েকবার সুতা পেঁচাতে হবে, যাতে কোনোভাবেই বাঁধা অংশ দিয়ে কাপড়ের ভেতরে রঙ প্রবেশ করতে না পারে। এ পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করা হয় এজন্য যেন, বস্ত্রটি যখন রঙ করা হয় তখন ঐ স্থানগুলোতে যেন রঙ প্রবেশ না করতে পারে। এভাবে রঞ্জিত এবং অরঞ্জিত বস্ত্র মিলে একটি বর্ণাঢ্য এবং সুন্দর নকশা সৃষ্টি হয়।
বন্ধন প্রক্রিয়াটি ৪টি উপায়ে করা হয়। যথা-
ক) সুতা দিয়ে বেঁধে
খ) কাঠি দিয়ে ভাঁজ করে বেঁধে
গ) সেলাই করে
ঘ) গিঁট দিয়ে
বন্ধন প্রক্রিয়ার উপকরণগুলো হলো-
বস্ত্র, সুতা, আলপিন, সেফটিপিন, নুড়ি, বোতাম, ধান+সরিষার দানা, কাঠি, ম্যাচের কাঠি।
(০৪) রঙ প্রস্তুতকরণঃ
প্রথমে আধা গ্যালন গরম পানিতে এক কাপ ইউরিয়া, চার চা-চামচ লুডিগল, এক চা-চামচ ওয়াটার সফটনার ভালোভাবে মিশিয়ে পানি তৈরি করতে হবে। যাকে কেমিক্যাল পানি বলে। এই কেমিক্যাল পানির সঙ্গে এবার রঙ মেশাতে হবে। যদি কেমিক্যাল পানি তৈরি করা সম্ভব না হয়, তাহলে শুধু গরম পানিতে রঙ মেশাতে হবে। গাঢ় ও উজ্জ্বল রঙের বানাতে চাইলে প্রতি কাপ পানির সঙ্গে দুই থেকে চার চা-চামচ রঙ আর হালকা রঙের জন্য আধা চা-চামচ থেকে দুই চা-চামচ পর্যন্ত রঙ মেশাতে হবে। সাধারণত এক গজ কাপড়ের জন্য এক চা-চামচ রঙ ব্যবহার করতে হয়।
টাই-ডাইয়ের জন্য আমরা নিচের রঙগুলো ব্যবহার করতে পারি। যেমন-
ক) প্রুশিয়ান রঙ
খ) নেপসল রঙ
গ) ইন্ডিগো রঙ
ঘ) সালফার ব্লাক
(০৫) রঙ করার পদ্ধতিঃ
প্রথমত ইচ্ছা অনুযায়ী কাপড়টিকে বাঁধতে হবে। বাঁধার পর একটি গামলায় ঠান্ডা পানি নিয়ে পাঁচ মিনিট কাপড়টিকে চুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর কাপড়টিকে তুলে হাল্কাভাবে চিপে নিতে হবে। এরপর প্রস্তুতকৃত রঙযুক্ত পানিতে কাপড়টিকে চুবিয়ে ১৫-২০ মিনিট নাড়াচাড়া করতে হবে। পরবর্তীতে তিন চা-চামচ লবণ+রঙ মেশানো পানিতে আবার কাপড়কে ৩০ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। এভাবে রঙ করার কাজ শেষ হবে।
(০৬) রঙ করার পরে করণীয়ঃ
পাত্র থেকে কাপড় তুলে পরিষ্কার ঠান্ডা পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। আলগা রঙ বের হওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাপড় ধুতে হবে। তারপর খুব সাবধানতার সাথে সুতার বাঁধনগুলল খুলে নিতে হবে, যাতে এক স্থানের রঙ অন্য স্থানে না লাগে। তবে অবশ্যই ২৪ঘন্টা, সম্ভব হলে আরো বেশি সময় পরে বাঁধন খুলতে হবে। গরম পানিতে সম্পূর্ন কাপড়কে ১০ মিনিট সিদ্ধ করতে হবে। সবশেষে, কাপড়কে উঠিয়ে ঠান্ডা পানিতে কয়েকবার ধুয়ে, বাতাসে শুকিয়ে নিয়ে, শুকনো কাপড় আয়রন করে নিতে হবে।
টাই-ডাই করা কাপড়ের যত্নঃ
=>টাই-ডাই করা কাপড় অন্য কাপড়ের সঙ্গে ধোয়া যাবে।
=>কাপড় ধোয়ার আগে কাপড়ের এক কোণা পরীক্ষা করে নিয়ে দেখতে হবে রঙ ওঠে কিনা। যদি ওঠে, তবে পানিতে ডিটারজেন্ট দিয়ে সামান্য লবণ মিশিয়ে কাপড় পরিষ্কার করতে হবে।
=>চাদর বা কুশন ধোয়ার আগে এর গায়ের লেবেলটি ভালোভাবে পড়ে নিতে হবে।
=>কাপড় ধোয়ার পরে রঙিন কাপড় ভিনেগার মেশানো পানিতে চুবিয়ে হালকা চিপে রোদে দিতে হবে। এতে কাপড়ের উজ্জ্বলতা ঠিক থাকবে।
=>প্রাকৃতিক রঙ করা কাপড় ড্রাই ওয়াশে দেওয়া যাবে না। এতে কাপড়ের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যায়।
=>সিল্কের টাই-ডাই কাপড় শ্যাম্পু দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এতে কাপড় অনেক নরম থাকে।
=>কোনোভাবেই ঘন ঘন ধোয়া যাবে না টাই-ডাই করা পোশাক।
=>রোদে কাপড় উল্টিয়ে দিয়ে শুকাতে হবে। এতে রঙ দীর্ঘদিন ভালো থাকবে।
=>এই ধরনের কাপড় নিজ হাতে বাড়িতে ধোয়াই ভালো।
=>অতিরিক্ত শ্যাম্পু দিয়ে ভিজিয়ে রেখে কাপড় পরিষ্কার করা যাবে না। এতে কাপড় শক্ত ও রঙ নষ্ট হয়ে যাবে।
বর্তমানে 'টাই এন্ড ডাই' শিল্পটি পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে বিশেষভাবে সমাদৃত। রুচিশীল শিল্পপ্রিয় মানুষ মাত্রই পোশাক পরিচ্ছদে এ নকশা পছন্দ করে। তাই পরিশেষে বলা যায়, পোশাক পরিচ্ছদে নকশা করতে মূল ও মিশ্র রঙের নানা প্রকার চমক সৃষ্টিতে 'টাই এন্ড ডাই'(Tie & Dye) একটি সুন্দর এবং চমৎকার উপায়।
তথ্যসূত্রঃ গুগল এবং বই।
লেখক পরিচিতঃ
আছিয়া আক্তার
১ম বর্ষ, ব্যাচ-২৪
সেশনঃ ২০১৯-২০২০
বস্ত্রপরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প বিভাগ
বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ।
কানিজ ফাতেমা
১ম বর্ষ, ব্যাচ-২৪
সেশনঃ ২০১৯-২০২০
বস্ত্রপরিচ্ছদ ও বয়নশিল্প বিভাগ
বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ।