▪ মোটা সুতার পোশাক নাকি ক্রেতারা কম পছন্দ করেন! কিন্তু জিন্স? যুগের পর যুগ ধরে জনপ্রিয়তায় অন্যদের টেক্কা দিচ্ছে। তরুণদের কাছে তো বটেই, মধ্যবয়সীরাও পরছেন জিন্স। সাদা কার্পাস তুলা দিয়ে তৈরি মোটা সুতা। সেই সুতায় বোনা ডেনিম কাপড়ের ওপর নানা ধরনের রং আর ওয়াশের পর তৈরি হয় জিনসের একেকটি পোশাক। জিন্স বলতে মূলত ডেনিম থেকে তৈরী ট্রাউজার বা প্যান্টকেই বোঝানো হয়। অর্থাৎ বলতে গেলে ডেনিম যদি হয় আলু, তাহলে জিন্স হবে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই! ডেনিম হচ্ছে কাঁচামাল, জিন্স হচ্ছে এর পরিণত অবস্থা। সেই সুবাদে বলা যায়,
❝সকল জিন্সই ডেনিম, কিন্তু সকল ডেনিম জিন্স নয়।❞
ধারণা করা হয় সিদিয়ান অঞ্চল (বর্তমানে ইউক্রেইন, বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া) থেকে আধুনিক প্যান্টের আবির্ভাব হয়েছে। এই অঞ্চলের মানুষেরা বড় বুট জুতার ভেতর ঢুকিয়ে ঢিলেঢালা প্যান্ট পরতো। এই এলাকার প্রাচীন কবরস্থান থেকে আবিস্কার করা একটি পাত্রে আঁকা ছবিতে দেখা যায়, একজন যোদ্ধা প্যান্ট পরে আছে। পাত্রটি খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭০ বছর পরানো। গ্রিক ইতিহাসবিদ হারোডোটাস উল্লেখ করেন, সিদিয়ানরা ছাড়াও গ্রিক পুরাণে উল্লেখিত নারীযোদ্ধা, যারা অ্যামাজন নামে পরিচিত, তারাও প্যান্ট পরতো। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭০ বছর আগের বিভিন্ন চিত্রকর্মে সেই চিত্রই ফুটে ওঠে। জিন্সের সঠিক ইতিহাস জানা না থাকলেও প্রচলিত রয়েছে লেভি স্ট্রস নামের এক ভদ্রলোক ১৮৫১ সালে জার্মানি থেকে নিউইয়র্কে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন শুকনো মালামাল সাপ্লাই দিতেন। এর মধ্যে কাপড়ও রয়েছে। ১৯৫৩ সালে তিনি সানফ্রান্সিসকোতে চলে যান, ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য। ১৮৭২ সালে লেভি স্টসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে জ্যাকব ডেভিসের সঙ্গে, যিনি পেশায় একজন দর্জি ছিলেন। তিনি নিয়মিত লেভির কাছ থেকে কাপড় সংগ্রহ করতেন। একদিন জ্যাকব অফার করেন লেভি পার্টনারশিপ ব্যবসা শুরু করার জন্য। এবং ভিন্ন কিছু প্রোডাক্ট তৈরির জন্য। প্রথমেই মনযোগী হন প্যান্টের দিকে। মোটা কটনের কাপড় ব্যবহার করা হবে প্যান্টে যা হবে দীর্ঘস্থায়ী। এবং এই কটন কাপড় জার্মানি ভাষায় বলা হয় জিনিয়া, যা বর্তমানে জিন্স হিসেবেই পরিচিত। এই জিন্স প্যান্টের বাটন হুক এবং ব্যাক পকেট ডিজাইন লেভির করা। এবং তার দু’জনে মিলে প্যাটেন্ট কিনে ছিলেন জিন্স প্যান্ট ব্যবসার। জিন্সের পেছনে লেভেল লাগান লেভি স্ট্রস এ্যান্ড কোং। জিন্সের সেই আদি রূপ হয় যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকু।
▪দিন যত যাচ্ছে তত পরিবর্তন ঘটছে সমাজের নানা আঙ্গিনায়। নতুনত্বের আলিঙ্গন ঘটছে পুরোদমে। উচ্ছ্বসিত মন থেকে পুরনো কালি রেখা দূর করায় সচেষ্ট সবাই। নিজের বাহ্যিক আবরণ উজ্জ্বল করা, নিজের ব্যক্তিত্বকে আরও বেশি করে ফুটিয়ে তোলার আয়োজন চলছে চারদিকে। তবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই এ ধারাটা বেশি লক্ষ্য করা যায়। পুরনোকে ভেঙ্গে নতুনের আবাহনে গা ভাসানোতেই আনন্দ তাদের। তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকালে সব সময় একটা চমক লক্ষ্য করা যায়। সেটা পোশাক আশাকে কিংবা চালচলনে যেটাই হোক না কেন। ফ্যাশন ট্রেন্ডের ধারাবাহিক পরিবর্তন তরুণ প্রজন্মকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। নিত্যনতুন ঘারানার পোশাক আন্দোলিত করে তাদের। মাঝে মধ্যেই তারা ফ্যাশন ট্রেন্ডের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করে থাকে। আবার পুরনো পোশাককে নতুন রূপ দেয়ার মাধ্যমেও ভিন্নতা আনা হয়ে থাকে। সেটাতেও ভিন্ন ধরনের ফ্লেবার পাওয়া যায়। তেমনি একটি পোশাক হচ্ছে জিন্স।
▪জিন্স প্যান্ট প্রধানত চার প্রকারের হয়ে থাকে-
১. এমব্রয়ডারি জিন্স।
২. রংচটা জিন্স।
৩. স্লিম জিন্স।
৪. স্ট্রেইট কাট জিন্স।
▪জিন্স প্যান্টের সামনে ক্ষুদ্র পকেটের ইতিহাসঃ
কখনও ভেবে দেখেছেন, আপনার জিনসের সামনে ডান দিকে ওই ছোট্ট পকেটটা কেন থাকে? পিছনে দু’টি পকেট, সামনে প্রমাণ সাইজের পকেট তো আছেই। তাহলে! অনেকে ভাবতে পারেন ওই পকেটটা নিছকই স্টাইল করার জন্য। কেউ ভাবতে পারেন খুচরো পয়সা রাখার জন্য। আসলে উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় আমেরিকার কাউবয়রা এই জিন্স পরা শুরু করেন। জিনসের সামনে ওই ছোট্ট পকেটটি রাখা শুরু হয় তখনই। ওই ছোট্ট পকেটে তারা পকেট ঘড়ি রাখতেন। সেই ঘড়ি একটি চেন দিয়ে বেঁধে রাখা থাকত। আজ আর পকেট ঘড়ির ব্যবহার নেই। কিন্তু ঘড়ির পকেটটি ঠিকই রয়ে গেছে।
▪জিন্স প্যান্টে ৩ টি বোতাম থাকার ইতিহাসঃ
কখনও ভেবে দেখেছেন, জিন্স প্যান্টের পকেটের কাছে যে তিনটি বোতাম দেখা যায়, সেই তিনটি বোতাম কেন থাকে? স্রেফ স্টাইলই যদি হত, তা হলে সব প্যান্টে নিশ্চয়ই থাকত না। জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসে। জিন্স কারা পরতেন? মূলত শ্রমিক, যাদের কায়িক শ্রমের পরিমাণ ছিল বিপুল। কারখানা বা অন্যত্র কাজ করার সময়ে প্যান্ট হামেশাই ছিঁড়ে যেত। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিঁড়ত পকেট বা পকেটের কাছে। অথচ এই পকেট ছিল শ্রমিকদের কাছে মহামূল্যবান বস্তু। ১৮৭৩ সালে এলো আমূল পরিবর্তন। লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোম্পানির এক সাধারণ ক্রেতা, পেশায় দর্জি জেকব ডেভিস নিয়ে এলেন সমাধান, যা জিন্সের ডিজাইনই পুরোপুরি বদলে দিল চিরতরে। সেলাইয়ের উপরে পকেটের কোণ ঘেঁষে তিনটি তামার বোতাম সেঁটে দেন তিনি। স্রেফ তিনটি ছোট্ট বোতাম বড় সমস্যার চিরকালীন সমাধান এনে দেন। এর পেটেন্ট চেয়েছিলেন জেকব। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থ না-থাকায় তিনি পেটেন্ট পাননি। তবে ইতিহাস তাকে ভোলেনি।
▪হিপহপ জিন্সঃ
১৯৯০ সালের পর থেকে জিন্স ফ্যাশনে আবার পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এ সময়ে জিন্স ফ্যাশনের ক্ষেত্রে পপ সংগীতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সময়ের হিসেবে এই সময়কে বলা হয় ‘গ্রাঞ্জ’ যুগ। গ্রাঞ্জ মূলত একধরনের রক সঙ্গীত যেখানে ধীরগলায় গান গাওয়া হয়, গিটারের আওয়াজও থাকে কর্কশ। কার্পেন্টার জিন্স (কাঠমিস্ত্রিদের পোশাকের মত) এবং জিন্সের আপদমস্তক পোশাকের প্রচলনও শুরু হয় এ সময়ে। এগুলো অনেকটা শ্রমিকদের পরিহিত ওভারল পোশাকের মতো দেখতে। কিন্তু এই জিন্সসমূহ তরুণীদের মধ্যে বেশি প্রচলিত ছিলো।
▪ব্যাড বয় জিন্সঃ
১৯৫০ সালের শুরুর দিকে এই জিন্সের আবির্ভাব দেখা যায়। জিন্সের এরূপ নামকরণ আসলে একটু প্রশ্নবোধক। মূলত এই সময়ে জিন্স তরুণ সমাজের কাছে এক অভ্যুত্থানের অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সেসময়ে নামকরা বিপ্লবী তরুণ অভিনেতা, কিংবা পপ তারকারা তাদের পরিধেয় পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছিলো জিন্সকে। সেসময়ের তরুণদের আদর্শের অন্যতম উৎস ছিলো তারকাদের পোশাক-পরিচ্ছদ অনুকরণ করা। তরুণ অভিনেতা জেমস ডিন, মার্লন ব্রান্ডো তাদের সিনেমাতে জিন্স ব্যবহার করতে শুরু করেন। ফলে তরুণেরা সেই ফ্যাশনের অনুকরণে জিন্স পরা শুরু করে।
▪হিপ্পি জিন্সঃ
হিপ্পি যুগের শুরু হয়েছিলো ১৯৬০ সালের পর থেকে। তারুণ্যে উদ্দীপ্ত হয়ে ভালোবাসাকে মুক্ত করে দেয়ার যে আন্দোলন আমেরিকাতে চলেছিলো ১৯৬০ এর পরে, একেই হিপ্পি যুগ বলে। হিপ্পি যুগেও ডেনিম জিন্সের ছিলো এক অনবদ্য ভূমিকা। বিশেষ করে ডেনিমের ব্লু জিন্স ছিলো হিপ্পি জনগোষ্ঠীর নৈমিত্তিক পরিধেয়। সেসময়ে মুক্ত চিন্তাধারাকে প্রকাশ করতে অন্য সব পোশাক পরিচ্ছদের থেকে জিন্স ছিলো সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। এই যুগে জিন্সের স্টাইলে আরো পরিবর্তন আসতে শুরু করে। কারণ মুক্ত চিন্তাধারাকে প্রকাশ করতে ১৯৫০ এর ধূসর, রঙচটা জিন্সতো আর ব্যবহার করা যায় না। হিপ্পিদের জিন্স হতে হবে এমন কিছু যা তাদের নিজেদের সৃজনশীলতা এবং ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরে। হিপ্পি জিন্সে প্রথম এমব্রয়ডারি করা নকশা দেখতে পাওয়া যায়। এই জিন্স ছিলো সাধারণত উজ্জ্বল বর্ণের। কখনো কখনো স্টোন ওয়াশিং ইফেক্ট, রাইনোস্টোন এবং প্যাচ পকেটের ব্যবহারও হতো হিপ্পি জিন্সে।
▪স্কিনি জিন্সঃ
স্কিনি জিন্স ২০০০ সালের প্রথমদিকে সবার নজরে আসে। ব্রিটনি স্পিয়ার্স কিংবা ক্রিস্টিনা আগুইলেরাদের মতো পপ তারকারা স্কিনি জিন্সকে পরিচিত করান। স্কিনি জিন্সের ক্ষেত্রেও এদের রাইজ, অর্থাৎ জিন্সের দুই পায়ের সংযোগস্থল থেকে কোমর পর্যন্ত দূরত্ব ছিলো খুবই কম। কাজেই উপরের দিকে এটি যথেষ্ট আটসাট ছিলো। যেহেতু তরুণ প্রজন্ম পপ তারকা কিংবা অভিনেতাদের ফ্যাশনকে অনুকরণ করে, সেহেতু স্কিনি জিন্সও সাধারণ মানুষের ফ্যাশনে পরিণত হতে শুরু করে। তবে স্কিনি জিন্স বিশেষ করে নারীদের জন্যই উপযুক্ত ছিলো। পুরুষদের জিন্সের ক্ষেত্রে তেমন একটা পরিবর্তন এই সময়ে লক্ষ্য করা যায়নি।
▪জিন্স আমেরিকানাঃ
১৯৬০ সালে আমেরিকাতে যে উল্টো সংস্কৃতির আন্দোলন শুরু হয়েছিলো, অর্থাৎ হিপ্পি যুগের শুরু হয়েছিলো, সেখানে ডেনিমের ছিলো অন্যরকম অবদান। কিন্তু ডেনিম জিন্সের প্রভাব সাধারণ আমেরিকান সংস্কৃতিতেও পড়েছিলো। এই জিন্স মূলত ১৯৭০ এর পরে আমেরিকার স্বচ্ছ লিঙ্গবিভেদ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলো। অর্থাৎ, নারীদের জন্য একরকম জিন্স, পুরুষের জন্যে অন্যরকম। এসময়ে নারীদের জন্য ডেনিমের স্কার্ট ও ডেনিম ভেস্ট এর ব্যবহার শুরু হয়।
▪কিছু কৌশল অবলম্বন করলে বার বার ব্যবহারের পরেও জিনসের পোশাকটি থাকবে নতুনের মতো।
এবার সেই কৌশল সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
১. ডেনিম ধোয়ার জন্য ভরসা রাখুন ঠাণ্ডা পানিতে। গরম পানি এই জিন্সের জন্য ভালো নয়।
২. অত্যধিক ক্ষারযুক্ত সাবানে ডেনিম কাচবেন না। এতে এর রং ফিকে হয়ে যায়। তাই ক্ষারযুক্ত সাবান বাদ দিয়ে মৃদু সাবানে ধুয়ে নিন জিন্স পোশাকটি।
৩. কিছুক্ষণ সাবান-পানিতে ভিজিয়ে রাখুন জিন্স। তারপর হালকা করে ঘষে তুলে নিন জিনসের নোংরা জায়গাগুলো।
৪. মনে রাখবেন জিন্স নিংড়াতে হয় না। বরং টানটান করে মেলে পানি ঝরিয়ে নিন। খানিক ক্ষণ পর রোদে দিয়ে শুকিয়ে ফেলুন।
৫. রং টেকসই করে রাখতে অবশ্যই উল্টো করে রোদে শুকাতে দিন। কাচার সময়ও উল্টো করে কাচুন।
৬. ডেনিমের পায়ের ফোল্ডে ময়লা জমে বেশি, তাই ব্রাশ দিয়ে হালকা করে ফোল্ড ঘষে নিতে পারেন।
বাজারে জিন্স প্যান্টের চাহিদা অনেক। বিভিন্ন ডিজাইনের এসব জিন্সের ওপর নজর রয়েছে ক্রেতাদের। ন্যারো, বেলবাতাম, স্ট্রেট এসব জিন্সের চাহিদা বর্তমানে বেশি। আবার প্যান্টের কালারটাও হওয়া চাই পারফেক্ট। এদিকে আবার কাপড় স্ট্রিচ নাকি নন স্ট্রিচ সেটিও যাচাই করতে ভোলেন না ফ্যাশনপ্রিয়রা। কালার নিয়েও যথেষ্ট সচেতন সবাই। ব্ল্যাক, ব্লু, হালকা নেভি ব্লু এসব জিন্সের চাহিদা অনেক।
Writer:
Sajjadul Islam Rakib
Dept. of Textile Engineering
National Institute of Textile Engineering and Research-NITER (10th Batch)