“Bengal has hundred gates open for entrance but not one for departure.”
▪ষোড়শ শতকের শেষের দিকে ভ্রমণে আসা জ্যাঁ ব্যাতিস্ত টার্ভানিয়ার প্রাচীন বাংলাদেশ সম্পর্কে এমনই মন্তব্য করেছিলেন। প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ ইতিহাস ঘাটালে আমরা দেখতে পাই বাংলার আকর্ষণে মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ নানা সময়ে এই বাংলায় ছুটে এসেছেন।
কী ছিলো প্রাচীন বাংলায় যাতে মুগ্ধ হতেন পর্যটকেরা? স্বর্ণ-হীরার খনি কিংবা রূপার পাহাড় কিছুই ছিলো না; ছিলো উদার প্রকৃতি, নদীবিধৌত উর্বর সবুজ ফসলের মাঠ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নদী, ইলিশ এবং আভিজাত্যের প্রতীক মসলিন। আর ছিলো এ দেশের সহজ সরল মানুষ, তাদের আবহমান সংস্কৃতি। সংস্কৃতি আর ঐশ্বর্যের এই মহা সমারোহের অমোঘ আকর্ষণে তারা ছুটে আসতেন আমাদের এই বাংলায়।
▪বাংলা মসলিন শব্দটি আরবি, ফার্সি কিংবা সংস্কৃতমূল শব্দ নয়। মসলিন শব্দটি এসেছে `মসূল` থেকে। ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র হলো মসূল। এই মসূলেও অতি সূক্ষ্ণ কাপড় প্রস্তুত হতো। এই `মসূল` এবং `সূক্ষ্ণ কাপড়` -এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতিসূক্ষ্ণ কাপড়ের নাম দেয় `মসলিন`। অবশ্য বাংলার ইতিহাসে `মসলিন` বলতে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ণ একপ্রকার কাপড়কে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আদি ও অকৃত্রিম ঐতিহ্যের এক অনন্য নাম মসলিন তথা ঢাকাই মসলিন। মসলিন অত্যন্ত সূক্ষ, মিহি, বিশুদ্ধ, উজ্বল এবং মোলায়েম একপ্রকার বস্ত্রবিশেষ যা মুঘল আমলের প্রাচীন বাংলার এক অপূর্ব সম্পদ ছিলো। অনেকের মতে ইরাকের বাণিজ্যনগরী মসুল থেকে মসলিন নামটি এসেছে। মসলিন মুঘল আমলের বাদশাহী ও খানদানী নারী-পুরুষ এবং উচ্চপদধারী বিত্তবানদের পোশাক ছিলো। মসলিন প্রস্তুত করা হতো বর্তমান বাংলাদেশের সোনারগাঁও অঞ্চলে, এছাড়াও ধামরাই, তিতবাড়ি এবং জঙ্গলবাড়িতেও মসলিন বয়ন করা হতো। চিত্তাকর্ষক অপরূপ এ কাপড়টি বোনা হতো হাতে। চড়কায় সুতো কেটে হাতে বোনা এই মিহি কাপড় তৈরিতে প্রয়োজন হতো সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের এর সুতো। কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ মসলিন বয়নে ব্যবহৃত অতি চিকন সুতো ফুটি কারপাস নামক তুলো থেকেই তৈরি হতো। কোনরূপ প্যাটার্ন ছাড়াই দক্ষ হাতের কারিগরী দক্ষতায় তৈরি মসলিন এতটাই সূক্ষ ছিল যে একটি আংটির ভেতর দিয়ে প্রায় কয়েক গজ কাপড় প্রবেশ করানো যেত। কথিত আছে যে, মসলিনে তৈরি করা পোশাকসমূহ এতই সুক্ষ্ম ছিলো যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেতো।
▪অ্যা স্কেচ অফ দ্য টপোগ্রাফি এন্ড স্ট্যাটিস্টিকস অফ ঢাকা’ বইয়ে মসলিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে জেমস টেলর লেখেন, “ঢাকাই মসলিন মানুষের কাজ নয়। এটা পরীদের কাজ।” মসলিন তৈরির পেছনে জড়িয়ে আছে অনেক না বলা গল্প। এই এত দামের মসলিন যারা তৈরি করতো, তাদের জীবন যে খুব একটা সুখের ছিলো তা কিন্তু নয়। খুবই মানবেতর অবস্থায় তাদের দিন কাটতো। লাভের বেশির ভাগই লুফে নিতেন ফড়িয়া ও মুনাফালোভী বণিকরা।
মসলিন তৈরি হতো মূলত ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে। মসলিন তৈরির জন্য শীতলক্ষ্যার পাড়ের আবহাওয়া ছিলো সবচেয়ে উপযুক্ত। মসলিনে সুতা এতই সূক্ষ্ম ছিলো যে সকাল কিংবা সন্ধ্যাবেলার শীতল আর স্নিগ্ধ পরিবেশ ছাড়া এই সুতা কাটাই যেতো না। অনেকে মনে করেন, ১৮ থেকে ৩০ বছরের মেয়েরাই এই সুতা কাটতে পারতো।
▪বাংলার মসলিন শিল্প তার সোনালী সময়ে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, কার্পাস উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রি- পুরো চক্রটা ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকার আশেপাশে চাষ হতো ফুটি কার্পাস। এই ফুটি কার্পাসকে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ পৃথিবীর সেরা জাতের কার্পাস বলে ধারণা করেন। এই কার্পাস চাষাবাদেও ছিল নানা ধরনের নিয়মকানুন। কার্পাসের বীজ বছরে দুইবার বপন করা হতো, শরত এবং বসন্তকালে। বসন্তকালের কার্পাস থেকে উৎপাদিত তুলাকে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মনে করা হতো। সাধারণত মসলিন তাঁতিদের কেউ কেউ নিজের জমিতে কার্পাসের চাষ করতেন, অনেকেই চুক্তি ভিত্তিতে নিজের জমিতে কার্পাস চাষ করে মসলিন তাঁতিদের কাছ থেকে দাম বুঝে নিতেন। ভালো ফসল হলে বিঘাপ্রতি দুই মণ কার্পাসের ফলন পাওয়া যেত।
এরপর কার্পাস থেকে তুলা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া, বীজসহ কার্পাসকে বোয়াল মাছের চোয়ালের দাঁত দিয়ে বানানো চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে তুলা থেকে অপদ্রব্য আলাদা করে নেওয়া হয়। এই কাজে দরকার দক্ষতা আর ভীষণ ধৈর্য। খুব ছোটবেলা থেকেই পারিবারিকভাবে তাঁতিদের সন্তানদের হাতেখড়ি হতো এসব কাজে, ফলে পরিণত বয়সে এসে তারা খুবই দক্ষ হয়ে ওঠে।
এরপর তুলা থেকে সুতা কাটার কাজ শুরু হয়, এই কাজটি সাধারণত পরিবারের নারী সদস্যরা করে থাকতেন। শুকনো বাতাস বইতে থাকলে সুতা কাটা সম্ভব নয়, সূক্ষ্ম সুতা কাটার জন্য বাতাসে আর্দ্রতা দরকার। তাই খুব ভোর থেকে শুরু করে সকালের রোদ উঠার আগে এবং বিকালে সূর্যাস্তের আগের সময়ে সুতা কাটার কাজটি করা হতো, এমন জনশ্রুতিও আছে আর্দ্র বাতাসের জন্য নদীতে ভাসমান নৌকায় সুতা কাটার কাজ করা হতো। সুতা কাটায় সূক্ষ্মতার জন্য দুটি গুণের দরকার ছিল, একটি প্রখর দৃষ্টিশক্তি, অন্যটি হাতের আঙ্গুলের প্রখর চেতনা শক্তি।
▪ঢাকাই মসলিনঃ
শুধু মসলিন না বলে ঢাকাই মসলিন বলা ভাল। কারণ ঢাকার অদুরে ডেমরা এলাকার তাঁতিদের মস্তিষ্কপ্রসূত এই শিল্প কর্মের জন্য একসময় ঢাকা ছিল বিখ্যাত। ঢাকার তৎকালীন মোঘল বাদশাহদের বিলাসব্যসন ছিল এই মসলিন।
মসলিন এতই সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে বোনা হত যে কয়েকশো গজ মসলিন একটি ছোট্ট আংটির ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে বের করে আনা সম্ভব ছিল। শুধুমাত্র কারিগরি দক্ষতার জিনিস নয় এই মসলিন। এটি গড়তে শিল্পীমনেরও দরকার। হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী মসলিন। গবেষক বার্ড উড প্রমুখ পণ্ডিত গবেষণা করেছেন যে, ঢাকাই মসলিন প্রাচীন এশিরীয় ও ব্যাবিলনে বিশেষ খ্যাতিলাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। উইলফোর্ড মন্তব্য করেছেন—একটি ব্যাবিলিয়ন বস্ত্র ফিরিস্তিতে ঢাকাই মসলিনের উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বিলাস-ব্যসনেও ঢাকাই মসলিন ব্যবহূত হতো। মিশরের প্রাচীন কবরে বাংলাদেশের নীলে রঞ্জিত ও মসলিনে জড়ানো মমির সন্ধান পাওয়া গেছে। ইয়েট বলেন—খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ঢাকাই মসলিন গ্রিসে বিক্রি হতো।
▪উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের কাপড়ের বাজারে মসলিনের চাহিদা ছিল না বললেই চলে। তাই তাঁতিদের হাত থেকে মসলিন চলে যেত মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের হাতে, সেখান কয়েক হাত বদলে থেকে চড়া দামে মসলিন কিনতেন উঁচুতলার মানুষেরা। মসলিনের দামের সুফল কি সেই তাঁতিরা পেয়েছিলেন যারা এই কাপড় বুনতেন কিংবা সেই কার্পাস চাষীরা যারা জমিতে মসলিনের কাঁচামাল চাষ করতেন?
তাছাড়া দীর্ঘ দিনে ধরে ইংরেজরা বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে, সেখান থেকে নিজেদের কুঠির লোকজন দিয়েই মসলিন সংগ্রহ করা শুরু করে, পরবর্তীতে সেখান থেকেই বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়। দেশীয় মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সাথে বিদেশীরাও যুক্ত হয়, ধীরে ধীরে তারা দেশীয় এবং বিদেশী প্রতিযোগীদের হারিয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তাই ইউরোপের বাজারে প্রশংসিত হওয়ার সাথে সাথে যখন মসলিনের চাহিদা বাড়ে তখন থেকেই দেশীয় বাজার থেকে মসলিন সংগ্রহের ব্যাপারে ইংরেজরা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া শুরু করে। কিন্তু সেই জায়গাটিও বদলে যেতে শুরু করে ম্যানচেস্টারের কাপড়ের কল আসার পর।
▪মসলিনের বিলুপ্তিঃ
মুঘল আমলে মসলিন তৈরিতে বহু পৃষ্ঠপোষকতা করা হতো। মূলত পলাশী যুদ্ধের পরপরই এর পসার কমতে শুরু করে। ঢাকা রাজধানীর মর্যাদা হারিয়ে শহর হিসেবে এর গুরুত্ব যেমন কমে যাচ্ছিলো, তেমনি মসলিন শিল্পেও ভাঙ্গন ধরে। ইংরেজরা বহু তাঁত নষ্ট করে দেয়, তাঁতীরা যাতে মসলিন তৈরি করতে না পারে সেজন্য তাদের বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া হয়। আবার অনেকে মনে করেন, তাঁতীরা স্বেচ্ছায় নিজেদের আঙ্গুল কেটে ফেলেছিলেন যাতে মসলিন তৈরি করতে না হয়। মূলত অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থা, বাজারধ্বস, কাঁচামালের অপ্রাপ্যতা, জলবায়ু পরিবর্তন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে সম্পূর্ণভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যায় মসলিন। এখন শুধু জাদুঘরেই এর দেখা মেলে।
মসলিন ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা গেলে বাংলাদেশের এক সোনালি অধ্যায় পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত হবে।
সারা বিশ্বের কাছে এখন বাংলাদেশের পরিচিতি গার্মেন্ট কারখানার দেশ হিসেবে, তাকে অনেকে বলেন দর্জির দোকান। কিন্তু, কাপড় নিয়ে একসময় এ অঞ্চলের মানুষের কীরকম ঐতিহ্য ছিল মসলিনই তার নিদর্শন। মসলিন শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নয়, রেশমের মতো তা সমগ্র পৃথিবীরই সম্পদ।
Writer:
Sajjadul Islam Rakib
Campus Ambassador- Textile Engineers
NITER (10th Batch)