আমরা কমবেশি সকলেই মোটামুটি “3 Idiots” মুভিটি দেখেছি। মনে আছে, আমির খান কিভাবে মেশিনের সংজ্ঞা চেইনের মাধ্যমে দিয়েছিলেন? মেশিনের সংজ্ঞায় বলেছিলেন, যেটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলো সহজ করে তুলে সেটিই মেশিন। আমাদের প্রত্যেকের প্যান্ট, ব্যাগ কিংবা লাগেজে চেইন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাহলে চলুন, চেইন বা জিপার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু জানা যাক….
জিপার বা চেইন মূলত কিছু খাঁজকাটা দাঁতের সমন্বয়ে তৈরি একটি নমনীয় যন্ত্রাংশ। চেইনের বেশিরভাগ অংশে দুটি সারিতে বিভক্ত বিশেষ আকৃতির ধাতব বা প্লাস্টিকের দাঁত থাকে। একটি স্লাইডার দাঁতগুলোর সারি ধরে এগিয়ে এসে তাদের আবদ্ধ করে।স্লাইডারটি হাত দিয়ে টানতে হয় এবং এর অভ্যন্তরে ইংরেজি ‘Y’ আকারের একটি চ্যানেল থাকে। স্লাইডারের গতিপথের উপর নির্ভর করে দাঁতগুলো আবদ্ধ বা পৃথক হয়। অদ্ভুত একটি বিষয় হলো,স্লাইডারটি ব্যবহারের সময় যে জিপ আওয়াজটি হয়,সেখান থেকেই এর নাম রাখা হয় জিপার।
◽ আবিষ্কারের ইতিহাসঃ ১৮৯১ সালে “হুইটকম্ব জডসন” হুকের মতো একটি বন্ধনী জুতা খোলা ও লাগানোর জন্য আবিষ্কার করেন। যদিও এটি তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি কিন্তু জডসনকে জিপারের আবিষ্কারক বলা হয়। এরপর বিভিন্ন কোম্পানিগুলো এর সংস্করণ করতে থাকে। মজার বিষয় হলো, ১৯৩০-এর দশকে, শিশুদের পোশাকে জিপারের ব্যবহার শুরু হয়েছিল এবং এর কারণ ছিল ছোট বাচ্চাদের নিজেদের পোশাক পরিধানের সুযোগ দিয়ে তাদের মধ্যে স্বনির্ভরতা জাগ্রত করা।
◽ প্রকারভেদ:
➡টিথের সাইজের উপর ভিত্তি করে-মূলত জিপার বন্ধ অবস্থায় দাঁতের প্রস্থ যত মিলিঃ হয়,সেই পরিমাপ অনুযায়ী নাম্বারিং করা হয়। যদি বন্ধ অবস্থায় টিথের মাপ ৬মিলিঃ হয়,তবে একে T6 বলা হয়। এভাবে প্রস্থের উপর ভিত্তি করে জিপারের শনাক্তকরণ একটি সহজ পদ্ধতি। এক্ষেত্রে ক্রমঅনুযায়ী নাম্বার বৃদ্ধির সাথে সাথে জিপার দেখতে বড় বা প্রশস্থ হয়।
➡দাঁতের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে-
i) Metal Zipper: মেটাল জিপার মূলত মৌলিক প্রকৃতির জিপার। এই ধরণের জিপার বেশিরভাগ জিন্সের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।মেটাল জিপারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এই জিপারের দাঁতগুলো শক্তভাবে জিপারকে আবদ্ধ রাখে। সেজন্য দাঁত তৈরির সময় ধাতু অনুসারে বিভিন্ন ধরনের পলিশ করা হয়।বিভিন্ন কেমিক্যাল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে এসব পলিশ করা হয়। সাধারণত পিতল কিংবা অন্যান্য ধাতব উপকরণ এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।এই জিপারের স্থায়িত্বকাল অন্যান্য জিপারগুলোর চেয়ে বেশি। তাই মেটাল জিপারকে উচ্চ শক্তি ও বেশি মাত্রায় ধোয়ার প্রয়োজন এসব ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার করা হয়।
ii) Coil Zipper: বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বিক্রিত জিপার হলো কয়েল জিপার। এটি দেখতে অনেকটা সর্পিলাকার বা কুন্ডলি আকৃতির। সাধারণত কয়েলগুলোর ভিতর দিয়ে একটি কর্ড চলমান থাকে। কয়েল জিপারগুলো পলিয়েস্টার কয়েল দিয়ে তৈরি হয়,তাই একে পলিয়েস্টার জিপারও বলা হয়। অন্যদিকে,এর অপর নাম নাইলন জিপার।
iii) Vision Zipper: অনেকটা ধাতব জিপারের মতো ভিসলন জিপারের পার্থক্য হল এই জিপারে প্লাস্টিকের দাঁত ব্যবহৃত হয়। তাই এই জিপার মেটাল জিপারের তুলনায় অনেকটা হালকা। রেজিন জাতীয় প্লাস্টিক পদার্থ দিয়ে তৈরি হয় এই জিপারের দাঁত। ভিসলন জিপার বিভিন্ন রঙের পাওয়া যায়। বিভিন্ন ছোট প্লাস্টিকের ব্যাগ ও অন্যান্য দরকারী স্টেশনারির জন্য কিংবা কাপড়ে ব্যবহারের জন্য এই জিপার অধিক জনপ্রিয়।এই জিপারের অন্য নাম প্লাস্টিক জিপার।
এছাড়া আরো কিছু জিপার দেখা যায়। সেগুলো হলো-
i) Invisible Zipper: এই জিপারের ক্ষেত্রে টিথ এবং দাঁতগুলো অনেকটা লুকানো অবস্থায় থাকে। এই জিপারে হালকা লেইসের মতো ফেব্রিক ব্যবহৃত হয়। সামরিক বা জরুরি পরিষেবাগুলোতে এই ধরনের জিপারের ব্যবহার লক্ষণীয়।
ii) Open-ended Zipper: এই জিপারের ক্ষেত্রে উপরের ও নিচের প্রান্তে বাক্স আকারের লক থাকে। জিপারটি লাগানোর জন্য স্লাইডারের নিচের প্রান্তটি অপর দাঁতের নিচের প্রান্তের বাক্সে সংযুক্ত করতে হয়। এরপর স্লাইডারটি চালালে দাঁতগুলো একে অপরের সাথে আবদ্ধ হয়। মূলত, জ্যাকেটে এ ধরনের জিপার ব্যবহৃত হয়।
iii) Close-end Zipper: এই ধরণের জিপারের একদিক বন্ধ থাকে। জিন্সের প্যান্টে ক্লোজ-ইন্ড জিপার ব্যবহৃত হয়।
◽ Airtight and Waterproof Zipper: এয়ারটাইট জিপারে সাধারণ দাঁত ব্যবহার করা হলেও ওয়াটারপ্রুফ জিপারের দাঁতগুলো কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। এর দাঁতগুলোর প্রতিটি সারির বাইরের অংশে আবৃত থাকে। জিপারটি বন্ধ করলে উপর ও নিচের দিক শক্তভাবে আবদ্ধ হয়। ফলে পানি ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। এয়ারটাইট জিপারগুলো মূলত স্পেস স্যুট তৈরির জন্য প্রথমে ‘নাসা’ তৈরি করেছিল। এই স্যুট উচ্চচাপ সহ্য করতে সক্ষম এবং শূন্যস্থানেও স্যুটটির অভ্যন্তরে বায়ুচাপ বজায় থাকে।
জিপার অর্থাৎ চিইন অনেক পোশাক কিংবা অন্যান্য অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসে ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত প্যান্ট, জ্যাকেট, ব্যাগ, লাগেজ, টি-শার্টের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ও নতুন নতুন ডিজাইন ও স্টাইলের জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ক্রীড়া সামগ্রীর ব্যাগ, তাবু এবং স্লিপিং ব্যাগেও এর ব্যবহার দেখা যায়। আবার এই চেইনের জন্য আমাদের জীবনে অনেক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন- ব্যাগের চেইন কখনও নষ্ট হলে অনেক বেশি দূর্ভোগ পোহাতে হয়। অনেক সময় ভুলবশত চেইন খোলা থাকে। এটা বাচ্চা ছেলেদের কাছে নিছক মজার হলেও বড়দের জন্য হতে পারে বিব্রতকর পরিস্থিতির কারণ। আবার অনেক সময় মেয়েদের জামার পিছনে জিপার থাকলে, সেটা লাগানোও অনেক কষ্টকর হয়। যদিও ছেলেদের সমস্যাটাই অনেকটা বড়, বিশেষ করে সম্মানহানী হওয়ার সম্ভাবনা তাই এদিকে কিছুটা খেয়াল ও সাবধান হওয়া আবশ্যক।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, Textile learner, টেক্সটাইল ম্যানিয়া।
Written by:
Md.Istiaque Hossain Ullash
Dept. of Fabric Engineering (2nd batch)
Dr. M A Wazed Miah Textile Engineering College,Pirgonj,Rangpur.