প্রাচীনকাল থেকে এই উপমহাদেশে হস্তচালিত খাদি ছিল জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু এ শিল্পের প্রচার প্রসার ঘটে ১৯২০ এর দশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়কালে। ‘স্বরাজ’ প্রতিষ্ঠার জন্য স্বদেশী পণ্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং খাদি কাপড় হতে পারে এর অন্যতম উদাহরণ- এ চেতনাকেই জাগ্রত করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এ কারণেই স্বদেশী আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত খাদি কাপড়।
নামকরণ :
খাদি কাপড়ের নামকরণ নিয়ে রয়েছে মতবাদ। দ্রুততার সাথে কাপড় তৈরির জন্য মাটির নিচে গর্ত করে পায়ে চালানো প্যাডল দ্বারা এ কাপড় তৈরি হতো। খাদ থেকে তৈরি হতো বলে এর নাম হয় খদ্দর বা খাদি।আবার অনেকে বলে থাকে খদ্দর শব্দটি গুজরাট শব্দ।এই শব্দ থেকে খাদি বা খদ্দর হচ্ছে।
কুমিল্লায় খাদির প্রসার:
ব্রিটিশ ভারতে ১৯২১ সালের দিকে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের সময়কালে কুমিল্লায় ব্যাপক সাড়া জাগে এবং খাদি বস্ত্র উৎপাদনও বেড়ে যায়। একটি পেশাজীবী সম্প্রদায় তাঁত শিল্পের সাথে তখন জড়িত ছিলেন তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘যুগী’ বা ‘দেবনাথ’। ১৯২১ সালে মহাত্মা কুমিল্লার চান্দিনা অঞ্চলে আসেন এবং বিদেশী কাপড় ছেড়ে দেশী কাপড় ব্যবহারে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি নিজে চরকার ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণও দেন! গান্ধীজীর প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লার অভয় আশ্রম খাদি শিল্প প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর তৎকালীন কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ও বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ড.আখতার হামিদ খান ও তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগীতায় দ্য খাদি এন্ড কটেজ ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। তখন চান্দিনাতে ড.আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠিত দি খাদি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড এর হাল ধরেন চান্দিনার শৈলেন গুহ ও তার ছেলে বিজন গুহ।কুমিল্লার খাদি কাপড়ের ঐতিহ্যের সঙ্গে সারাজীবন জড়িয়ে থাকবে শৈলেন গুহ এর নাম। তিনি সবার কাছে ‘খাদিবাবু’ নামেই পরিচিত! কুমিল্লার চান্দিনার খাদির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে তিনি দীর্ঘদিন এর উন্নয়নের পেছনে কাজ করেছেন। তার পরবর্তী প্রজন্ম এখনো খাদিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৯৪ সালে কুমিল্লার খাদিশিল্প তাদের গুণগত মানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়।
খাদির বর্তমান অবস্থা:
কুমিল্লার চান্দিনা, মুরাদনগর ও দেবিদ্বারে সহস্রাধিক তাঁতশিল্প রয়েছে। এই সব অঞ্চলের তাঁতশিল্পীরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এ সুনাম খ্যাত শিল্প কে ধরে রাখার জন্য।তুলার অপর্যাপ্ততা এবং চাহিদার সীমাবদ্ধতা। বর্তমানে মেশিনের সাথে পাল্লা দিয়ে হস্তচালিত তাঁত দ্বারা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে খাদির কাপড়ের যথেষ্ট চাহিদা না থাকলেও দেশে এবং বিদেশে ছোট-ছোট লটে খাদি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। ফ্রান্স, স্পেন, ডেনমার্ক, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই পণ্য রপ্তানি হয়। গুহ পরিবারের বর্তমান উত্তরসূরি আরুন গুহ বলেন, ভবিষ্যতে এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে বছরে অন্তত একটি করে হলেও খাদি বা খদ্দরের জামা সকলের কেনা প্রয়োজন।
খাদি দ্বারা কি তৈরি হয়?
এক সময় ফ্যাশন জগতে খাদি দিয়ে শুধু পাঞ্জাবি তৈরি করা হতো। কিন্তু বর্তমানে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়াসহ আরো নানা পোশাক তৈরি হয়। শুধু পোশাক নয়, খাদি কাপড় দিয়ে তৈরি বিছানার চাদর, বালিশের কভার, সোফা ও কুশনের কভার, পর্দা, শীতের চাদরও এখন বেশ জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলোর মধ্য একটি হলো খাদি। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে সেই ১৯২০ সালের মত ২০২০ সালেও আমাদেরই স্বদেশী পণ্য ব্যবহারে এগিয়ে আসতে হবে।
Writer information:
Ashik Mahmud
Department of Textile Engineering
National Institute of Textile Engineering & Research